তনয়া ভট্টাচার্যকে আপনাদের মনে থাকার কথা। শেষ মৃত পাখি যারা পড়েছেন তারা তাকে চেনেন। একটা বড় ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট জমা দিয়ে সে দিন দশেরকের জন্য চলে আছে গঞ্জ নামের এক মৃত শহরে ছুটি কাটাতে। তার পরিকল্পনা ছিল দিন পাঁচেক সে থাকবে এখানে তারপরের পাঁচদিন থাকবে কলকাতায় নিজের বাসায়। কিন্তু তখন তারা জানা ছিল না যে পুরো দশদিন বাদেও আরও অতিরিক্ত পাঁচদিন ছুটি নিয়ে তাকে এখানে থাকতে হবে।
এই শহরের অদ্ভুত কিছু গল্প রয়েছে। রয়েছে রহস্য, রয়েছে অতীত, ভয়ংকর অতীয়। অনেক পাপ এখানে লুকিয়ে আছে। অনেকেই অনেক কিছু জানে তবে কেউ সত্যিটা বলে না। নিজেদের ভেতরেই অন্যায় লুকিয়ে রাখে। তনয়ার এই সবের ভেতরে প্রবেশের কোন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তারপরেও সে ঢুকে পড়ে। যে স্যাংচুয়ারিতে উঠেছিল তার মালিক বারবারার অনুরোধে সে গল্পটা শুনতে রাজি হয়। তার ভাইয়ের ছেলে ক্রিস আজ থেকে ৩০ বছর আগে এই বাসা থেকেই হারিয়ে গেছে। মাত্র পনের মিনিটের মধ্যে কেউ কি ক্রিস কিভাবে হারিয়ে গেল সেটা কেউ জানে না। কেউ ঠিক বুঝতেই পারে নি যে এতোগুলো মানুষের ভেতরে একটা বাচ্চাকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা।
পুরো গল্পটা শোনার পরে কেবল শখের বসেই তনয়া খোজা শুরু করে। তখনই সে জানপারে যে কেবল ক্রিসই নয়, ক্রিসের হারিয়ে যাওয়ার বছর ছয়েক আগে আরও একজন মানুষ এই শহর থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। তার নাম অ্যাগনেস। তাকে যেন শহরের মানুষ একেবারে ভুলে গেছে। কিন্তু তনয়া তাকে আবার জাগিয়ে তোলে। সে শুরু করেছিল ক্রিসের হারিয়ের রহস্য খুজে বের করা দিয়ে কিন্তু একটা সময়ে তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় অ্যাগনেস কিভাবে হারিয়ে গেল আর কেন হারিয়ে গেল সেই রহস্য খুজে বের করা! বিশেষ করে যখন স্যাংচুয়ারির ভাঙ্গা অংশ থেকে অ্যাগনেসের ছবি আর তার হাতে লেখা চিঠি বের হয়ে এল তখন তনয়ার মনে হতে লাগল যে অ্যাগনেসের ব্রাউন পরিবারের কোন না কোন সম্পর্ক আছে, ক্রিসের হারিয়ের সাথে অ্যাগনেসের হারিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। তাই অ্যাগনেসের রহস্য খুজে বের করতে হবে আগে। যখন আস্তে ধীরে কিছু কিছু রহস্য বের হয়ে আসতে শুরু করল তখন স্যাংচুয়ারিতে ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে যায়। তনয়াকে গঞ্জ ছেড়ে চলে আসতে হয়।
তারপর তিন বছর আবারও সে গঞ্জে ফিরে ফিরে আসে। ফিরে আসতে হয় তাকে। কারণ গঞ্জে আরও একটা অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। এবার একজন খুন হয়েছে। সেই খুনের তদন্তের ভার পরে সিআইডির হাতে। সিআইডি হাজির হয় তনয়ার কাছে। তাদের মনে হয় যে এই খুন তিন বছর আগের সেই গঞ্জের ঘটনা এবং ত্রিশ বছর আগের ঘটনার সাথে জড়িত।
সেই তিন বছর আগের ঘটনার পর থেকে তনয়ার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সে কর্মক্ষেত্র ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসেছে। সেখানেই সে নিজের ভেতরে থেকেছে, দিনের পর দিন ঘরবন্দী রেখেছে আর দিনের পর দিন ভেবেছে। সে সমাধান খুজেছে। তারপর আবারও ফিরে এসেছে গঞ্জে। এবার সে একটা গল্পটা নিয়ে এসেছে। যদিও সেই গল্পের স্বপক্ষে প্রমান তার কাছে নেই।
সেই গল্পে সে কী বলল? ক্রিস আর অ্যাগনেসের হারিয়ে যাওয়ার গল্পের ? সেই গল্পের পেছনের কারণ? অপরাধ? বর্তমানের অপরাধ আর সেই ত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া অপরাধের গল্প!
শাক্যজিত ভট্টাচার্যের একটা মাত্র বই আমি পড়েছি আগে। শেষ মৃত পাখি। বইটা সত্যি বলতে আমার পড়া অন্য সেরা রহস্য উপন্যাস। তাই তার এই ‘নৈশ অপেরা’ পড়ার জন্য আমি একেবারে মুখিয়ে ছিলাম। এক্সপেক্টেশন বেশি ছিল বলেই হয়তো বইটা যখন শেষ করলাম তখন আমি পরিপূর্ণ ভাবে সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। শেষ মৃত পাখির মত এতোটা ভাল লাগল না। এই ভাল না লাগার পেছনে প্রধান কারণটা হচ্ছে লেখক গল্পটা অনেক বেশি জটিল করে লিখেছে। ৪০০ পেইজের একটা পড়ে শেষ করতে আমার এক দিনের বেশি লাগে না। এই বইটা শেষ করতে একটু সময় লাগল। তবে শেষ করে বেশ ভালই লাগল। তবে আগের গল্পের আদলের গল্পের কাহিনী কিন্তু বর্ণনা করার ধরণটা আলাদা এবং বেশ জটিল। আগের গল্পে গল্পের কথক শুধু তনয়া ছিল তবে এই গল্পে একাধিক কথক আছে যা কিনা গল্পের বর্ণনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। এবং একই কাহিনী একাধিকবার চলে এসেছে, হুবাহু না হলেই কাছাকাছি এই বর্ণনা একটু বিরক্তির কারণ ছিল।
এসব এক পাশে শেষ সরিয়ে যদি রাখি তবে গল্পের প্লটটা বেশ ভালই। একটা মৃত শহরের গল্প। কয়েকটা রহস্য। সেই রহস্যের পেছনে রয়েছে কতগুলো অপরাধ। তবে একেবারে শেষ অধ্যায়ে যখন অ্যাগনেসের হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা সামনে এল তখন আমার তার জন্য এক অদ্ভুত কষ্ট এসে জড় হল বুকে। এতোটুকু ছোট একটা মেয়ে, এই টুকু বয়সেই কত কিছুই না সহ্য করতে হল। কী কষ্ট আর নিঃসঙ্গতা নিয়ে সে পৃথিবীতে বেঁচে ছিল, সেই কষ্ট নিয়েই হারিয়ে গেল! এই কষ্টটা আমার বুকে লেগেছিল অনেকটা সময়!
যারা শেষ মৃত পাখি পড়েছেন তারা নৈশ অপেরা পড়তে পারেন। খারাপ লাগবে না আশা করি তবে যদি বেশি এক্সপেক্টেশন নিয়ে থাকেন তবে একটু হতাশ হতে হবে।