বুক রিভিউঃ ব্রাইডা এবং দ্য ফরটি রুলস অব লাভ

এই বছরে পড়া অন্যতম সেরা দুইটা বই হচ্ছে পাওলো কোয়েলহোর "ব্রাইডা" আর এলিফ শাফাকের দ্য ফরটি রুলস অব লাভ। এই বই দুটি নিয়ে আসলে কি লিখবো ঠিক বুঝতে পারছি না । মনে হচ্ছে যাই বলি না কেন সেটা হয়তো ঠিকমত বলা হবে না ।


পাওলো কোয়েলহোর লেখা নিয়ে আমার খুব একটা উচ্চ ধারনা ছিল না । তার দ্য এলক্যামিস্ট বইটার নাম ডাক খুব । কিন্তু সেটা পড়ে আমি খুবই হতাশ হয়েছিলাম । বুঝতে পারি নি আসলে মানুষ কেন এই বইয়ের এতো প্রসংশা করে । কিন্তু ব্রাইডা পড়ার পর আমার মনে হল আসলে এলক্যামিস্টের অনুবাদ পড়া আমার মোটেই উচিৎ হয় নি । আসল বইটাই পড়া দরকার ছিল । ব্রাইডার কাহিনী যে খুব আহামরি কিছু সেটা নয় কিন্তু আমাকে যেটা মুগ্ধ করেছে সেটা হচ্ছে পাওলো কোয়েলহোর লেখার ধরন । কিছু কিছু মানুষের গল্প বলার আলাদা ধরন থাকে যা একবার শুনলে বারবার শুনতে ই্চ্ছে করে, খুব সাধারন কাহিনীও তাদের মুখে হয়ে ওঠে অসাধারন । ব্রাইডার কাহিনীও আমার কাছে তেমন মনে হয়েছে । ব্রাইডা হচ্ছে এক আইরিশ মেয়ের কাহিনী । সে চাকরি করে একটা ভাল কোম্পানীতে । বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের ছাত্রী । তার একজন ভালবাসার মানুষ আছে লরেন্স নামের । সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । ছোট বেলা থেকেই তার জাদুবিদ্যার প্রতি গভীর টান । জীবনের আসল উদ্দেশ্য খোজা কিভাবে সেই জীবনের মানে খুজে পাওয়া যায় সেই জন্য সেই গুপ্ত বিদ্যা শিখতে খুব বেশি আগ্রহী ! ব্রাইডা এই গুপ্ত বিদ্যা শেখার জন্য ম্যাগাসের গিয়ে হাজির হয় । ম্যাগাস হচ্ছে একজন শিক্ষক যার এই আধ্যাতিক জগত সম্পর্কে গভীর জ্ঞান আছে । ম্যাগাস তাকে দেখার পরপরই বুঝতে পারে যে এই ব্রাইডাই হচ্ছে তার সৌলমেইট যার জন্য সে এতোদিন অপেক্ষা করছিল । সে নিজের মধ্যে একটা তীব্র ইচ্ছাবোধ করে ব্রাইডাকে সেই কথা বলার জন্য কিন্তু সেটা সে বলে না । ম্যাগাজ অপেক্ষা করে । সে জানে যে ব্রাইডা তার শিক্ষা পরিপূর্ণ করলেই ঠিকই বুঝতে পারবে সে ম্যাগাসই তার সৌলমেইট !
ব্রাইডা ম্যাগাসকে অনুরোধ করে শিক্ষা প্রদানের জন্য ! তাকে এই আধাতিক জগত সম্পর্ক চাঁদ এবং সূর্দের নিয়মনীতি !
ম্যাগাস তারপর ব্রাইডাকে অন্য আরেকজন শিক্ষকের কাছে পাঠায় ! ডাইনি উইক্কা ! উইক্কা তাকে ধীরে ডাইনি বিদ্যার সব কিছু শিক্ষা দিতে থাকে কিভাবে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন আনতে হবে কিভাবে ঐ আধ্যাতিক জগতের সাথে এই জগতের একটা সেতু তৈরি করতে হবে আর নানান কিছু । একটা সময় ব্রাইডার সকল শিক্ষা গ্রহন শেষ হয় ! মূলত সেই আধ্যাতিক জগতের সন্ধান শুরুর থেকে শেষে সেটা পাওয়ার পর্যন্তই হচ্ছে ব্রাইডার গল্পের কাহিনী !

পাওলো কোয়েলহোর গল্প বলার ধরনটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে । সাধারন কথার মাধ্যমে জীবনের অনেক গভীর বক্তব্য সে ফুটিয়ে তোলে নিজের লেখার মধ্যামে । এই ব্রাইডা গল্পটা কাহিনীর থেকেই গল্পটা কিভাবে বলা হয়েছে সেটাই মূখ্য ব্যাপার । অনেকটা গন্তব্যের থেকে গন্তব্যে যাওয়ার পথটাকেই এই গল্পে বেশি গুরুত্বের সাথে দেখানো হয়েছে যা মনকে বারবার ছুঁয়ে যায়, চিন্তাকে আরও একটু বেশি প্রসারিত করে !
সময় থাকলে পড়তে পারেন এবং অবশ্যই বাংলা অনুবাদ পড়বেন না । পাওলো কোয়েলহোর ইংরেজি কোন রকেট সাইন্সের ইংরেজি নয় । খুব সহজ এবং বোধগম্য । পড়তে একদমই কষ্ট হবে না !



এরপরের বইটার হচ্ছে, এলিফ শাফাকের "দ্য ফরটি রুলস অব লাভ" । বইটা মূলত সুফিবাদের উপর নির্ভর করে লেখা । আমি এর আগে সুফিবাদ, রুমি সাহিত্যের ঊপর লেখা কোন গল্প পড়ি নি । দ্য ফরটি রুলস অব লাভ একই সাথে দুটো গল্প । এখানে দুটি গল্প পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে । একটা গল্পে এক সাধারণ অসুখী গৃহিনী ভালবাসার জন্য ঘর ছেড়ে দেয় আর অন্য গল্পটা জালালুদ্দিন রুমির কবি রুমি হয়ে উঠার গল্প !

ইলা রুবেইনস্টেইন চল্লিশ বছর বয়স্ক সাধারন বিবাহিত মহিলা । তিন সন্তান সহ সে নর্দস্পটনে বাসবাস করে তার স্বামীর সাথে ! ইললার ইলার সাথে আমাদের দেশের সকল গৃহিনীদের জীবনের একটা ভাল মিল আছে । সে ২৪/৭ গৃহিনী । স্বামী সন্তান ছাড়া তার জীবনে আসলে করার মত আর কিছু নেই । স্বামী আকাম-কুকাম করলেও সেটা মেনে নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা কিংবা অভিনয় করে যাচ্ছে । বাইরে থেকে তাকে খুব সুখী একজন মানুষ দেখা গেলেও বাস্তবে সে একজন অসুখী মেয়ে ! ইলা যেন আমাদের বাস্তব সমাজ থেকে উঠে আসা এক চরিত্র ! যাই হোক, সাহিত্য পড়াশুনা করার কারনে একটা সময় সে একটা প্রকাশনা সংস্থায় লেটারেসী এডিটর হিসাবে একটা চাকরি নেয় । যেখানে তার কাজ হচ্ছে বিভিন্ন বই পড়ে সেটার ব্যাপারে একটা রিপোর্ট লেখা । সেই সংস্থা থেকে তাকে প্রথম এসাইনমেন্ট হিসাবে "সুইট ব্লাসফেমি" নামে একটা বইয়ের উপরে রিপোর্ট লিখতে দেওয়া হয় । বইটার লেখকের নাম আজিজ যেড যাহারা ! মূলত এই বইটা পড়তে গিয়েই তার জীবনটা একেবারে পাল্টে যায় । বই পড়তে গিয়ে সে লেখকের সাথে যোগাযোগ করে । লেখকের সাথে তার নিয়মিত ইমেইল আদান প্রদান হতে থাকে । সুইট ব্লাসফেমি গল্পটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা । গল্পটা আসলে জালাল উদ্দিন রুমির কবি রুমি হয়ে ওঠার গল্প । যদি সুইট ব্লাসফেমি গল্পের প্রধান চরিত্র হচ্ছে শামস অব তাবরিজ । শামস এমন একজন সুফি দরবেশ সে সারা জীবন পৃথিবীর নানান প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছে তার সঙ্গীর খোজে । এমন একজন মানুষের খোজে যার সাথে যে তার হৃদয়কে সম্পর্ক ভাবে উজার করে দিতে পারে । জালালুদ্দিন রুমি হচ্ছে সেই কম্পানিয়ন ! যাত্রা পথে শামসের সাথে নানান মানুষের দেখা হয় তাদের গল্প আমরা জানতে পারি তারপর এক সময়ে শামস আর রুমির দেখা হয়ে যায় । দুজন দুজনের মধ্যেই যেন হারিয়ে যায় । তারা আসলে একে অন্যের অভিন্ন রূপমাত্র !
এই দুই গল্প মূলত এক সাথে এগিয়ে যেতে থাকে । গল্পে এক দিকে ত্রয়োফশ শতাব্দির কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে অন্য দিনে ২০০৮ সালের ইলার কাহিনী । সুইট ব্লাসফেমির কাহিনী ইলার জীবনের উপর তীব্রভাবে প্রভাব ফেলে । সে জীবনকে নতুন ভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করে । একটা সময়ে এসে ইলা উপলব্ধি করে যে সে আজিজকে ভালবাসে ।


দ্য ফরটি রুলস অব লাভ বইটা পড়া শেষ করে আমার মনে একটা অদ্ভুদ অনুভূতি কাজ করা শুরু করেছে । মনে হয়েছে এতোদিন পরে আসলেই আমি মনের মন একটা বই পড়ে শেষ করেছি । আমি আসলে যে ভাবে জীবনকে দেখি কিংবা দেখার চেষ্টা করি বইটার কথা গুলোও যেন তেমনই । মানুষের জীবনের সব থেকে মূল্যবান জিনিস টা হচ্ছে ভালবাসা । যেখানে ভালবাসা নেই সেখানে একটা দিনও থাকা উচিৎ নয় । বইটাতে প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস এবং উপরওয়ালার প্রতি মানুষের ভালবাসার ধরনের ব্যাপারেও কথা বলা হয়েছে । কিভাবে উপরওয়ালাকে ভালবাসা উচিৎ, কিভাবে সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস, নিয়ম নীতি গুলো আমাদেরকে আমাদের মনের বিশ্বাস ভালবাসাকে পরিপূর্ন ভাবে বাইরে আসতে দেয় না, সেগুলোও বইতে দেখানো হয়েছে ।
পুরো সময়টাই পড়তে গিয়ে কেবল একটা ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছি যে আসলেই ই তো এমনই হওয়া উচিৎ সব কিছু কিন্তু সবাই কেন এই ভাবে ভাবে না ! কেন ভাবে না ? পৃথিবী যদি শামস অব বাবরিজের মত চিন্তার মত করে চলতো তাহলে সব কিছু আরও সহজ হয়ে যেত আরও একটু সুন্দর হয়ে যেত !