গল্পের মূল চরিত্রের নাম হচ্ছে আয়ানে। তার স্বামীর নাম ইয়েশিতাকা মাশিবা। আয়ানে পরিচালিত স্কুলের সহকারীর নাম হচ্ছে হিরোমি। এছাড়া ডিটেক্টিভ কুসানাগি এবং জুনিয়র ডিটেক্টিভ উতসুমি। কুসানাগির কলেজ জীবনের বন্ধু পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর মানাবু ইউকাওয়া। এই নামগুলো মনে রাখলে গল্প পড়তে সুবিধা হবে। জাপানি বই পড়তে গেলে আমার সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হয়, সেটা হচ্ছে এই নাম মনে রাখা। সব নামই আমার কাছে একই রকম মনে হয়।
আপনারা যারা জাপানি মার্ডার মিস্ট্রি পড়েছেন আগে, তারা জানেন যে অন্যান্য মার্ডার মিস্ট্রিতে খুনটা কে করেছে, সেটা আগে থেকে জানা যায় না। কিন্তু জাপানি বইয়ের ক্ষেত্রে আপনি ঠিক প্রথম থেকেই বুঝে যাবেন যে খুনটা কে করেছে। এবং আপনার অনুমান মিথ্যাও হবে না। মূল রহস্যটা হচ্ছে খুনটা কীভাবে হয়েছে, সেটাই বের করা। এই বেলাতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। ইয়েশিতাকা মাশিবা জীবনে সফল একজন মানুষ। তার জীবনের একটাই উদ্দেশ্য, তা হচ্ছে সন্তানের পিতা হওয়া। সে জীবনে বিয়েই করতে চায়, যাতে সে সন্তানের বাবা হতে পারে। সে তার জীবনসঙ্গিনী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা খোঁজে, যেন মেয়েটি তার সন্তানের জন্য আদর্শ মা হতে পারে। এমনভাবেই সে বেশ কয়েকটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। একসময় সে আয়ানের সাথে বিয়ে করে। তবে তাকে শর্ত দেয় যে বিয়ের এক বছরের ভেতরেই আয়ানে সন্তান ধারণ করতে হবে। সেই শর্ত আয়ানে পূরণ করতে পারে না। অর্থাৎ তার ভেতরে মা হওয়ার ক্ষমতা থাকে না। ইয়েশিতাকা তাই যখন ডিভোর্সের কথা বলে, তখন আয়ানে সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনেও নেয়। সে কেবল ইয়েশিতাকাকে জানায় যে কদিনের জন্য সে তার মা-বাবার সাথে দেখা করতে যেতে চায়। ফিরে এসে চূড়ান্ত কথাবার্তা বলবে।
যাওয়ার আগে আয়ানে তার স্কুলের সহকর্মী হিরোমিকে তার ঘরের একটা চাবি দিয়ে যায়। এই হিরোমির সাথেই ইয়েশিতাকার একটা পরকীয়া প্রেম চলছে। আয়ানে চলে যাওয়ার পরে হিরোমি ইয়েশিতাকার সাথে বাসাতেই দেখা করে। রাতে দেখাও থাকে। পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে হিরোমিকে ইয়েশিতাকা জানায় যে আজকে সন্ধ্যায় তারা একসাথে ডিনার খেতে যাবে। সে মোতাবেকই পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু হিরোমি যখন বিকেলে ফোন দেয়, তখন ইয়েশিতাকা ফোন ধরে না। ল্যান্ডলাইনে যখন ফোন দেওয়া হয়, তখনো ফোন ধরে না সে। মনে কু ডেকে ওঠে। বাসায় গিয়ে যখন হাজির হয়, তখন সে দেখে ইয়েশিতাকা মেঝেতে পড়ে আছে। তার পাশে পড়ে আছে কফির কাপ। যে আর বেঁচে নেই।
প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা ধরে নেওয়া হলে, খুব দ্রুতই বোঝা যায় যে এটা একটা খুন। খুনটা কে করেছে, এই প্রশ্নটার থেকেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে খুনটা আসলে কীভাবে করা হয়েছে! কফির সাথে আর্সেনিক এসিডের বিষ মিশিয়ে ইয়েশিতাকাকে খুন করা হয়েছে। কফিতে বিষ পাওয়া গেলেও পানির বোতলে বিষ পাওয়া যায়নি। ভাবটা এমন যে কেউ কফি বানানোর সময়েই তার কফির ভেতরে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেটা সম্ভব না। কারণ সেই সময়ে ইয়েশিতাকা বাসায় একা ছিল। নিজের জন্য সে একাই কফি বানিয়েছিল। ভাব দেখে মনে হবে যে সে নিজেই কফিতে নিজের হাতে বিষ মিশিয়েছে। অথচ সেদিন সন্ধ্যাতেই হিরোমির সাথে তার ডিনারে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। রেস্টুরেন্টও বুক করা হয়েছিল। যে কিছু সময় পরে তার প্রেমিকার সাথে ডিনার করতে যাবে, সে নিশ্চয়ই নিজে নিজে আর্সেনিক খেয়ে মরবে না।
প্রাথমিকভাবে হিরোমিকে সন্দেহ করা হয়, কারণ শেষ মানুষ হিরোমির সাথেই ইয়েশিতাকার দেখা হয়েছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে পুলিশ বুঝতে পারে যে হিরোমি খুনি নয়। তখন সন্দেহ গিয়ে পড়ে ইয়েশিতাকার স্ত্রী আয়ানের উপরে। অথচ খুনের সময়ে সে ছিল কয়েকশ মাইল দূরে। তার পক্ষে কোনোভাবেই কফির পানিতে বিষ মেশানো সম্ভব না। ডিটেক্টিভ কুসানাগির বিশ্বাস যে আয়ানে কোনোভাবেই তার স্বামীকে খুন করতে পারে না। প্রথম দেখাতেই ডিটেক্টিভ কুসানাগি খানিকটা আয়ানের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। অন্তত তার সহকারী জুনিয়র ডিটেক্টিভ উতসুমির তাই ধারণা। উতসুমির আরও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে খুনটা আসলে আয়ানেই করেছে। কিন্তু সেও ঠিক বুঝতে পারে না যে আয়ানে ঠিক কীভাবে বিষ মিশিয়েছে। সাহায্যের জন্য সে কুসানাগির কলেজ জীবনের বন্ধু পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর মানাবু ইউকাওয়ার কাছে গিয়ে হাজির হয়। এর আগেও প্রফেসর অনেকভাবে পুলিশকে সাহায্য করেছে। কিন্তু এইবার সেও বিপদে পড়ে যায়। সেও কোনো কূলকিনারা বের করতে পারে না। একসময় সে তো বলেই বসে যে এটা একটা পারফেক্ট মার্ডার।
অবশ্য এদিকে কুসানাগি তার তদন্ত চালিয়েই যায়। তার ধারণা হিরোমির চলে যাওয়ার পরে ইয়েশিতাকার কাছে অন্য কেউ এসেছিল। এমন কেউ যাকে সে চেনে। সে যখন জানতে পারে যে ইয়েশিতাকার অনেক প্রেমিকা ছিল, তখন সে এই প্রেমিকাদের খোঁজ করতে থাকে। এবং একসময় তার হাতে এমন কিছু তথ্য এসে হাজির হয় যে শেষ পর্যন্ত তার মনোভাব বদলাতে বাধ্য হয়।
বইটা বেশি বড় না। এক কিংবা দুই বসাতেই বইটা পড়ে ফেলা সম্ভব। বইয়ের কাহিনী একটু স্লো হলেও পড়তে খারাপ লাগবে না। বিশেষ করে আপনি নিজেও যখন বুঝতে পারবেন যে খুনি কে, কিন্তু এটা বুঝতে পারবেন না যে আসলে কীভাবে খুনটা করা হয়েছে, তখন আপনার মনের এই কৌতূহলটাই আপনাকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে, বইটা শেষ করার একটা স্পৃহা কাজ করবে। এবং যখন শেষ করবেন, তখন মনে হবে যে আসলেই এভাবে ঠান্ডা মাথায় আর এত দীর্ঘ ধৈর্য ধরে একজন খুন করতে পারে!
এই বই পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে বইয়ে সবাই একটু যেন বেশিই নম্র-ভদ্র। অবশ্য জাপানিরা এমনিতেই নম্র-ভদ্র, কিন্তু এই বইয়ের প্রতিটা চরিত্রই যেন ভদ্রতার চূড়ান্ত প্রতীক। এটা আমার কাছে খানিকটা মেকি মেকি ভাব লেগেছে। অবশ্য এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। আমি বড় হয়েছি বাঙালি সমাজে। আমাদের ভেতরে নম্রতা-ভদ্রতার বালাই নেই। তাই এইটুকু মনে হতেই পারে। আর অনুবাদের দিক দিয়ে বলব, মোটামুটি ভালোই অনুবাদ হয়েছে বইটার। তবে সালমান হক ‘কী’ আর ‘কি’ এই দুইটার নিয়ম একদম জানেন না। এতগুলো বই অনুবাদ করার পরেও এই দুইটার পার্থক্য যদি কেউ না জানে, তবে সেটা লজ্জাজনক।
