প্রহেলিকা, কুহেলিকা, যবনিকা

 গত শুক্রবারে তিনটা থ্রিলার বই এক সাথে পড়ে শেষ করলাম। বই তিনটার নাম প্রহেলিকা, কুহেলিকা আর যবনিকা। বই তিনটা মুনসুর হালিম সিরিজের বই। ছোট পরিসরে লেখা তিনটা বইকে উপন্যাস না বলে বরং উপন্যাসিকা বলাই ভাল। বই তিনটা পড়ে আমি যে খুব ইম্প্রেস হয়েছি সেটা বলব না তবে বইয়ের কাহিনী, প্লট বিন্যাস আর গল্পের গতি আমার পছন্দ হয়েছে। তবে কাহিনীর ভেতর কিছুটা প্লটহোল রয়েছে যা পড়ে কিছুটা আশাহত হয়েছি।

প্রথম বই দিয়ে শুরু করি। রাজধানীতে হঠাৎ করে একের পর খুন হতে থাকে। খুনগুলো হয় মূলত বাচ্চা ছেলে মেয়েদের। ভয়ানক ভাবে তাদের হত্যা করা হয়। খুন দেখে মনে হয় কোন বিকৃত মস্তিস্কের খুনী একের পর বাচ্চাদের মেরে ফেলছে। তবে কাহিনী মোড় নেয় যখন দেখা যায় যে এই খুনগুলোর ধরণ প্রকৃতি সব মিলে যাচ্ছে একজন বিখ্যাত থ্রিলার লেখক নিয়াজ আহমেদের বইয়ের কাহিনীর সাথে। বইয়ের কাহিনীতে ঠিক যেভাবে খুনগুলো করা হয়ে থাকে বাস্তবেও দেখা যায় ঠিক সেই ভাবেই খুন গুলোহচ্ছে। পুলিশ গিয়ে হাজির হয় লেখক নিয়াজের বাসায়। সেখানে গিয়ে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার খেয়াল করেন মনসুর হামিল। তিনি দেখতে পান যে যে খুন হওয়ার লাশের পাশ থেকে যে জিনিস পাওয়া গেছে সেই সব জিনিসগুলোর মালিক মূলত এই লেখক মুনসুর হালিম। সরাসরি সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে তার উপরে। তখন লেখক এক অদ্ভুত গল্প শোনান। তিনি জানান যে কদিন আগে তার বাড়িতে চোর এসেছিল। সম্ভবত সেই সময়ই এই জিনিসগুলো চুরি হয়েছে। এবং এই জিনিসগুলো চুরি হয়েছে মূলত তাকে ফাঁসানোর জন্যই। যখন পুলিশ প্রশ্ন করে কে তাকে ফাঁসাতে চাইছে তখন উত্তরে নিয়াজ আহমেদ বলে যে এমন একজন আছে। নাম তার প্রহেলিকা রয়। ফেসবুকের মাধ্যমে তার পরিচয় হয়েছে। তারা একে অন্যের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছিল তবে প্রথমবার যখন তাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল তখন সেই মেয়েটি তার সাথে দেখা করতে আসে নি। ঠিক এমন ঘটনা তার সাথে আগেও ঘটেছিল। ভালবাসার মানুষের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল পালিয়ে গিয়ে। সেই সময়েও সেই মানুষটি আসে নি। একই ঘটনা পরপর দুইবার ঘটার ফলে নিয়াজ বড় রেগে গিয়েছিল। পরে অবশ্য এই প্রহেলিকা রয় আবার তার সাথে যোগাযোগ করে, আবার দেখা করতে চায় তবে এইবার নিয়াজ আর আগ্রহ দেখায় না। তখন থেকেই নাকি এই আইডি থেকে তাকে হুমকি দেওয়া শুরু হয়। তাকে দেখে নেওয়ার কথা বলে।

এরপর মুনসুর হালিম তার মত করে তদন্ত চালিয়ে যায়। এক সময় কেসের সমাধানও বের হয়ে যায়। এই সিরিজের এই মধ্যে এই বইটাই আমার কাছে সব থেকে বেশি পছন্দ হয়েছে। এই বইটার কাহিনীটা বেশ চমৎকার তারপর লেখক যেভাবে গল্পটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেটাও আমার কাছে বেশ চমৎকার মনে হয়েছে। তবে একটা ব্যাপার আমার কাছে ভাল লাগে নি তা হচ্ছে যেভাবে ফেসবুকের পাসওয়ার্ড নিয়ে নেয়। এটা আমার কাছে বড় হাস্যকর মনে হয়েছে। এই অংশটুকু যদি লেখক অন্য ভাবে লিখতেন তাহলে পুরো বইটা আরও বেশি চমৎকার হত।


কুহেলিকা এই সিরিজের দ্বিতীয় বই। এই তিনটা বইয়ের ভেতরে এই বইটা আমার কাছে সব থেকে বাজে লেগেছে। এখানে বেশ কয়েকটা জায়গাতে প্লট হোক চোখে পড়ছে। একেবারে শুরু করে আযহারকে যখন কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় নিজের অফিস থেকে তখন আযহার বলে যে এই লিফট তার কাছে ৫ বছর ধরে পরিচিত, ৫ বছর ধরে যে জানে যে ব্যাজমেন্ট থেকে প্রধান সড়কে উঠতে ৩০ সেকেন্ড সময় লাগে। অথচ পরের অধ্যায়েই সে জানায় যে সে প্র্যাক্টিস করছেই দু বছর ধরে, এই অফিসটাও সে নিয়েছে বছর দুয়েক হল। তাহলে যে অফিস সে নিয়েছে দুই বছর সেই অফিসের বেজমেন্টের খবর সে ৫ বছর ধরে কিভাবে জানে?

যাক গল্পে ফেরা যাক। এই গল্পে আযহার একজন মনবিজ্ঞানী। সে দ্দুই বছর ধরে রোগী দেখছে। তার একজন প্রেমিকা ছিল। রেবেকা। কিন্তু তার সেই প্রেমিকা বড়লোক একজনের সাথে বিয়ে করে ফেলে। এই কষ্ট সে ভুলতে পারে না কিছুতেই। নিজে অন্যের মনের রোগ ঠিক করলেও তার মনের এই রোগ সে ঠিক করতে পারে না।

ঘটনা শুরু হয় যখন সে জানতে পারে যে তার সেই প্রাক্তন প্রেমিকা এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। শেষবারের মত সে গিয়ে হাজির হয় প্রেমিকাকে দেখতে। কিন্তু যখন প্রেমিকার মুখ সে দেখে তখন অবাক হয়ে যায়। কারণ মৃত মানুষটা তার প্রাক্তন প্রেমিকা নয়। তাহলে তার আসল প্রেমিকা গেল কোথায়? এখানে আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে রেবেকার বাবা মা মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও তাকে দেখতে আসে নি। এই সব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই আযহারের কাছে। সে সাহায্যের জন্য আযহার আসে মনসুর হালিমের কাছে। প্রথমে হালিম তাকে সাহায্য করতে রাজি হয় না। সে ভেবে নেয় যে আযহারের সম্ভব কোনো সমস্যা আছে। তবে ধীরে ধীরে সব যট খুলতে থাকে। তার প্রাক্তন প্রেমিকা রেবেকা কেন তাকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছিল, লাশের চেহারা আলাদা কেন হয়ে গেল কেন তাকে কেউ খুজে পাচ্ছিল না, এই সব একে একে সব পরিস্কার হয়ে ওঠে।

এই গল্পটাও বেশ ভাল। হালকা থ্রিলার হিসাবে চলে। তবে এখানে সব বড় একটা প্লট হোল হচ্ছে প্লাস্টিক সার্জারি করে একজন মানুষের চেহারা না হয় বদলে ফেলা গেল তাই বলে সব কিছু বদলে ফেলা সম্ভব? এতো ভালোবাসার মানুষ, তার সামনে থাকবে অথচ তাকে চিনতে পারবে না। প্লাস্টিক সার্জারি করে দেহের গঠন গলার স্বর সবই বদলে ফেলবে? এই ব্যাপারটুকু যদি লেখক অন্য ভাবে সাজাতেন তখন বেশ চলনসই একটা গল্প হত।


এরপরের বইটার নাম যবনিকা। এই বইটার শুরু হয় সাব্বির এবং মারিয়ার সকালবেলার বেডরুম থেকে। সাব্বিরের বয়স ত্রিশের আশে পাশে অন্যদিকে তার স্ত্রী মারিয়ার বয়স চল্লিশের আশে পাশে। মারিয়া একজন দেশ প্রসিদ্ধ বিজনেস ওম্যান আর সাব্বির একটা এনজিও কর্নধর। গল্প শুরু হতেই মারিয়া মারা যায় ব্রেকফাস্ট টেবিলে। ডাক্তারী পরীক্ষায় জানা যায় যে হার্টএটাকে মারা গেছে। পরে মারিয়ার মামা এসে সাব্বিরকে শাসিয়ে যায় যে সে থানায় মামলা করবে। এটা নাকি খুন। মামলা হয়, পুলিশী কার্যক্রম শুরু হয়। তবে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। এদিকে মনসুর সাব্বিরের সাথে দেখা করতে গিয়ে সেখানে নাবিলার সাথে দেখা হয়। প্রথম দেখাতেই নাবিলাকে মনসুরের মনে ধরে। নাবিলাও মনসুরের মত সাব্বিরের সাথে দেখা করতে এসেছে। সে একজন ইন্সুরেন্স ইনভেস্টিগেটর। মারিয়া মারা যাওয়ার আগে নিজের নামে যে ৫ কোটি টাকার লাইফ ইন্সুরেন্স করেছিল সেটার টাকা দেওয়ার আগে নাবিলা এসেছে তদন্ত করতে যে মৃত্যুটা স্বাভাবিক কিনা। সেখানে নাবিলার সাথে মনসুরের পরিচয়। সেখানেই নাবিলা বলে যে তার সন্দেহ সাব্বির টাকার জন্যই তার বউকে মেরে ফেলেছে। এই কাজে সে মনসুরের সাহায্য চায়। মনসুরও খুশি মনে রাজিও হয়। এদিকে মনসুর সাব্বিরের এক পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা করে। সেখানে জানতে পারে যে সাব্বির টাকার জন্যই মারিয়াকে বিয়ে করেছে। তার আগে একটা প্রেমিকা ছিল। সেই প্রেমিকাকে চিট করেই সে মারিয়ার সাথে বিয়ে করেছে। এটা জানার পরে মনসুরের সন্দেহ আরও বেশি হয়। এছাড়া সাব্বিরের বাসার কাজের মেয়ের সাথে কথা বলে মনসুর জানতে পারে যে মারিয়া আর সাব্বিরের মাঝে প্রায়ই ঝগড়া হত, একে অন্যের গায়ে তারা হাতও দিত। মারিয়ার সন্দেহ ছিল যে সাব্বির বুঝি অন্য কোন মেয়ের সাথে পরকীয়াতে জড়িয়েছে। সাব্বিরকে পুলিশ ধরে আবার ছেড়ে দিতে বাধ্যও হয়। লাশ যখন তোলা হয় তখন প্রথম পোস্টমোর্টেমে কিছুই পাওয়া যায় না। তখন উপরমহল থেকে আদেশ আছে যেন কেস দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে মারিয়ার ব্যাপারে অনেক কিছু জানা যায়। মারিয়াকে মনসুর যেভাবে জেনে আসছে মারিয়া আসলে তেমন কেউ নয়। এক সময় মনসুর আসলে সত্যের কাছে পৌছেও যায়। এটা শুধু খুনের গল্প না, এটার সাথে আরও বড় কিছু জড়িয়ে আছে। এই গল্পটাকে বেশ চমৎকার মনে হয়েছে। একটা জায়গাতে আমি বেশ চমকেও গেছি। মানে এমন একটা ঘটনা যে ঘটবে সেটা আমি মোটেও আশা করি নি।


খুব জটিল চিন্তা ভাবনা না করে হালকা মেজাজে এবং একটানে পড়ে শেষ করার মত থ্রিলার খুজলে এই তিনটা বই পড়ে দেখতে পারেন। আশা করি ভাল লাগবে। তবে পড়ার সময়ে প্লটহোলগুলোর ব্যাপারে একটু ছাড় দিতেই হবে।





প্রহেলিকা, কুহেলিকা, যবনিকা

লেখক নাজিম উদ দৌলা

প্রিমিয়াম পাব্লিকেশন্স