নটরাজ

 নটরাজ বইটার হাইপ দেখে বইটা কিনেছিলাম। শুরুর দিকে লেখকের নোট পড়েই খানিকটা দমে গেলাম। লেখক জানিয়েছেন যে এই বইটার আগে একই গল্পের থিম নিয়ে, একই নামে আরেকটা বই প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটা সেটারই বৃহৎ পরিসরে লেখা। বই শেষ করে আমার মনে হল প্রথমে সেই প্রকাশিত ১২০ পেইজের বইটাকে টেনে টেনে লম্বা করা ছাড়া আর কিছুই করা হয় নি। 

 নটরাজের গল্প আগে বলা যাক। এই গল্পে রাশাদ একজন সাংবাদিক। তবে তার পড়াশোনা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে। তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু জয়িতার মাধ্যমে সে যুক্ত হয় একটা ইন্ডিয়ান এক্সিপিডিশন টিমের সাথে। ভারত বাংলাদেশ যৌথ ভাবে বান্দরবানে একটা কিছু খুজতে যাবে তারা। রাশাদ তাদের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু অভিযান শুরু হওয়ার আগেই তাদের উপর নানান ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। রিসার্চ পেপার চুরি হয়ে যায়। যে ছেলেটা ঘুরতে গিয়ে ঘটনাক্রমে নটরাজের মূর্তি আবিস্কার করেছিল সেই ছেলেটাকে কে বা কারা হত্যা করে। কিন্তু রাশাদের কল্যানেই তারা অভিযানে গিয়ে হাজির হতে পারে। এক সময় তাদের সেই বহু কাঙ্খিত মন্দিরটাও খুজে পায়। মেজর কামরানের সাথে রাশাদদের দল মন্দিরে ঢোকে সেই প্রাচীন আবিস্কারের জন্য। 

অন্য দিকে পালিয়ান সেই একই জায়গা গিয়ে হাজির হয় তার ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে। রাশাদদের আগে আরেকটা দল এসেছিল পালিয়ানদের বাসায় তার ভাইকে গাইড হিসাবে নিয়ে যেতে। তারপর তারাই তার ভাইকে মেরে পানিতে ফেলে দেয়। এছাড়া আরও দুইটা দল সেই একই স্থানে গিয়ে হাজির হয়। মোটামুটি চমৎকার একটা থিমের গল্প। এর ভেতরে কিছুটা রহস্য কিছুটা থ্রিল আর কিছুটা ইতিহাস মিশ্রিত রয়েছে। সব মিলিয়ে চমৎকার থিমের গল্প। আগের সেই ১২০ পেইজের বইটা গল্প এই রকমই। আমার সেই বইটা পড়লেই মনে হয় ভাল হত।

এবার আসি পরের মোটা বইয়ের গল্পে। এই বইতেও ঠিক একই সাজানো হয়েছে। তবে এই বইতে আলাদা ভাবে চোল সমকার ঘটনা বর্ণনা হয়েছে। আলাদা ভাবে আরেকটা কাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে। এই কাহিনী কিভাবে যুবরাজ আদিত্য পাণ্ড্য রাজাকে পরাজিত করে তার রাজ্য দখল করে, কুলদেবতার মূর্তি ছিনিয়ে নেয়, তারপর নিজেই কিভাবে রাজ্যের ভেতর থেকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয় এসব বর্ণনা করা হয়েছে। দুইটা সময়ে ঘটনা মোটামুটি পাশিপাশি চলেছে। 

এবার আসি বইটা আমার কেন মোটেই ভাল লাগে নি, সেই হিসাবে। এটা একান্তই আমার নিজের কারণ।  

 প্রথম কারণটা হচ্ছ এই বইয়ের স্থুল বর্ণনা। এই অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা আমার একেবারেই অপছন্দ। লেখক ইচ্ছাকৃতি কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভাবে এই অতিরিক্ত বর্ণনা করে গেছেন। শুরুতেই একটা অপ্রধান চরিত্রের পেছনে ৪০টা পেইজ নষ্ট করেছেন। গল্পের জিতু চরিত্রের কাজ হচ্ছে সে বান্দরবনে যাবে এবং সেখানে হারিয়ে গিয়ে নটরাজমূর্তি আবিস্কার করবে। এখান থেকেই গল্পের শুরু। যে চরিত্র গল্পের শুরুতেই মারা যাবে তার পেছনে ৪০টা পেজ নষ্ট? এই অপ্রধান চরিত্রের পেছনে এতো স্থুল বর্ণনা আমার খুবই অপছন্দ। 

বাংলাদেশের নবীন লেখকদের ভেতর বলতে গেলে কেউই এই প্রচীন সময়কার গল্প ঠিক মত ফুটিয়ে তুলতে পারেন না। এই গল্পের লেখকের বেলাতেও আমার তাই মনে হয়েছে। একজন লেখক যখন বর্ণনা দিবেন পাঠক সেই দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পাবে নিজের কল্পনাতে। এই বেলাতে আমার চোখে কিছুই ধরা দেয় নি। পড়ে এমনে হচ্ছে যে কিছু হচ্ছে মাইর পিট হচ্ছে যুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু আসলেই যে কী হচ্ছে আমি ভাল করে কল্পনা করতে পারছি না। লেখক আমাকে সেই পুরানো সময়ে নিতে যেতে পারেন নাই। তবে একই সাথে যে যখন বর্তমান সময়ের বর্ণনা দিচ্ছে তখন আমি বেশ ভাল পরিস্কার বুঝতে পারছি। সেটা আমার মনপুত হয়েছে। 

এরপর লেখক এই বইয়ের সাথে অযাচিত এবং অপ্রয়োজনীয় ভাবে উপজাতি বাঙালি আর্মি সংঘাতের ব্যাপারটা ইচ্ছে করে যুক্ত করেছেন। কেন করেছেন আমি নিজে সেটা বুঝতে পারি নি। গল্পের সাথে এর দূর দুরান্তে কোন সম্পর্ক নেই অথচ পৃষ্টার পর পৃষ্টা এর পেছনে নষ্ট হয়েছে। সব থেকে হাস্যকর লেগেছে এই জোর করে এই তথ্য যুক্ত করার ব্যাপারটা। ধরেন আপনি একটা প্রাচীন মন্দিরের ঘরে বন্দী হয়ে গেছেন, আপনাকে বের হওয়ার পথ খুজে বের করতে হবে, আপনি তখন আপনার বন্ধুকে বললেন, আচ্ছা এবার তাহলে উপজাতি বাঙালির সংঘাতের ইতিহাস বল। ব্যাপারটা হাস্যকর লাগবে না? এইখানে ঠিক তাই হয়েছে। পালিয়ানের ক্ষেত্রেও লেখক একই ভাবে শান্তিবাহিনীর ইতিহাসে লিখে গেছেন। 

গল্পের আরেকটা অপছন্দের ব্যাপার হচ্ছে গল্পটার ফরমেট আমার কাছে ইংরেজি মুভির ফরমেট মনে হয়েছে। ইংরেজি মুভিতে আমরা কী দেখি, নায়ক বুদ্ধি খাটিয়ে পাজস সমাধান করে মন্দিরের রহস্য উদ্ধার করে নিয়ে আসে তারপর ভিলেন তার কাছ থেকে সেটা নিয়ে নেয়। এই গল্পেও ঠিক একই ফরমেটে ছিল। আমি বলছি না তিনি কোন মুভি থেকে কপি করেছে কিন্তু এই ফরমেট আমার আগে থেকেই পরিচিত। 

এছাড়া দুটো সময়কার কাহিনী অর্থ্যাত অতীত এবং বর্তমান সময়ের গল্প যখন পাশিপাশি চলে তখন গল্প দুটো এমন ভাবে চলে যেন পাঠক দুটো গল্পের মাঝে একটা সংযোগ খুজে পায়। কিন্তু এই বইতে তেমন কিছুই ছিল না। ধারে কাছেও না। মূলত দুটো সম্পূর্ণ আলাদা কাহিনী এক সাথে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বইতে। 

এই শেষ কারণটা অবশ্য আমার একান্তই নিজের। লেখক বান্দরবান আন্ধারমানিকের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে আমার মনে হয় নি যে লেখক কোন দিন এই অংশে গিয়েছেন। যেতে পারেন তবে তার বর্ণনা পড়ে আমার তা মনে হয় নি। আমি নিজে এই জায়গাগুলোতে গিয়েছি তাই আমি তার বর্ণনার পার্থক্য খুব ভাল করেই ধরতে পারছি। 

আমি আগেই বলেছি যে ঐ ১২০ পাতার বইয়ের গল্প আমার কাছে ভাল লাগত। যদি লেখক দক্ষতার সাথে অতীতের কাহিনীটা সত্যিই যুক্ত করতে চাইতেন সেটা আরও অল্প কাহিনীতেই সম্ভব হত। এতো স্থুল বর্ণনার কোন দরকার ছিল না। তিনশ থেক সাড়ে তিনশ পাতায় বইতেই এই কাহিনী খুবই চমৎকার ভাবে বর্ণনা করা যেত। তারপরেও যারা বড় বই পড়তে চান তারা পড়তে পারেন। আমি পরামর্শ আগের সেই ১২০ পাতার বইটাই পড়তে।