আমেরিকার দিনগুলি

 আমি আগে ব্যক্তিজীবনের গল্প পড়তে পছন্দ করতাম না। তবে বয়স একটু বৃদ্ধির সাথে সাথে এই উপলব্ধিটা এসেছে যে কেউ যখন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লেখে তখন নিজের চোখে দেখা বিশ্বকে সবার সামনে তুলে ধরে। ব্যাপারটা অনেকটা তার চোখেই পৃথিবীটা দেখা। আর এই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের আনন্দ দুঃখ বেদনার ব্যাপারগুলো আমাকে আস্তে আস্তে নাড়া দিতে শুরু করে। আমি একটা ব্যাপার যেভাবে অনুভব করছি অন্য মানুষ ঠিক একই ব্যাপার ভিন্ন ভাবে অনুভব করছে। তারপর থেকেই ব্যক্তি অভিজ্ঞতার বইগুলো আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ি। বিখ্যাত মানুষ তো বটেই, পরিচিত অপরিচিত যে কেউ এমন কিছু লিখলেই সেটা পড়ার চেষ্টা করি। সম্প্রতি ‘আমেরিকার দিনগুলি’ বইটা পড়ে শেষ করেছি। বইটা আমাদের ব্লগের একজনের। 

নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে দেশে ছেড়ে তিনি আমেরিকা গেছেন। সেই সময়ের গল্প নিয়ে বইটা। বইটা পড়ার সময় আমার মানসিক প্রস্ততি ছিল যে হয় বইটা অনেক ভ্রমন কাহিনী হবে অথবা তিনি আমেরিকা আসলে কী কীকরেছেন সেটার একটা বর্ণনা থাকবে। তবে বইটা পড়া শুরু করার পরপরই সেই ভুল ভাঙ্গল। এটা ঠিক ভ্রমন কাহিনী নয় আবার একেবারে শুধু তার আমেরিকার থাকার দিনগুলোর বর্ণনাও নয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরও নানান তথ্য। লেখক যখন যেখানে গিয়েছে সেই স্থান সম্পকীত অনেক তথ্য দিয়েছেন । এই ব্যাপারটা আমার কাছে চমৎকার মনে হয়েছে। 

গল্পের শুরুটা হয়েছে সেই নব্বয়ের দশকের কোন এক রাতের বেলা এয়ারপোর্ট থেকে। তখন রোজার সময়। রোজা রেখেই লেখক প্লেনে চড়লেন। যখন প্লেনে খাবার এয়ারহোস্টেস যখন খাবার দিতে এল তখন লেখক তাকে জানালেন যে তিনি কিছু খাবেন না। তিনি রোজা আছেন। এই কথা এয়ারহোস্টেস ঠিক মনে রাখল এবং যখন ইফতারির সময় হল তখন নিজ থেকেই লেখকের জন্য খাবার নিয়ে এল। এই ব্যাপারটা লেখককে যেমন মুগ্ধ করেছিল আমাকেও জানি মুগ্ধ করলো। তারপর সেই ক্যাথিরিনের কথা যার সাথে লেখকের কোন দিন দেখা হয় নি তবুও সে লেখকের মনে এক গভীর স্মৃতি চিহ্ন ফেলে রেখে গেছেন। ক্যাথিরিনের পর্বটা পড়ার পরে আমার হঠাৎ করেই মনে হল যে এই ঘটনা যদি আমাদের দেশের কোন মানুষ করতো তাহলে সে কী করতো? আমি প্রায় নির্ভুল ভাবেই সেটা অনুমান করতে পারি। এরপর লেখকের মনে সে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের এর সিডি না কিনতে পারার আক্ষেপ পড়ার পরে আমি নিজের সাথে সাথে বেশ ভাল করেই ব্যাপারটা মেলাতে পারলাম । সেদিন যদি এতো দাম দিয়ে তিনি সেই সিডিটা কিনে নিতেন তাহলে কি এই অক্ষেপটা তার মনে থাকত? বরং যদি সেই সিডিটা সেদিন সে কিনে নিতো তাহলে তার মনে এই আপসোসটা আসতো যে এতো দাম দিয়ে এই সিডিটা কেনার কোন দরকার ছিল না। তারপর তার প্রিয় প্রফেসর সাইমনের সাথে কাটানো স্বপ্নের মত কিছু সময়ের পড়ার সময় মনে হল লেখক এখানে বুঝি তার আনন্দ ভাললাগা মুগ্ধতা আর বিস্ময়গুলো ঠিকমত যেন প্রকাশ করতে পারেন নি। আসলে এমনটা হওয়াটা স্বাভাবিক। হঠাত করেই যখন এমন কিছু মানুষের সামনে চলে আসে যা জন্য সে ভাবে নি তখন সে সঠিক ভাবে ভাষায় প্রকাশ বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তারপর তার বাংলাদেশ ডের গল্প পড়তে আমার হুমায়ুন আহমদের বাংলাদেশ নাইটে লেখাটার কথা মনে হল। যদিও হুমায়ুন আহমেদের মত এমন কিছু এখানে হয় নি। 

এই বইয়ের আরেকটা উল্লেখযোগ ব্যাপার হচ্ছে লেখক কেবল আমেরিকার গল্প বইতে করেন নি বরং সেই সাথে আমাদের সাথে একটা তুলনার চিত্র তুলে ধরেছেন প্রায় প্রতিটা অধ্যায়ের শেষে। সেই থেকে পড়তে গিয়ে থাকতে গিয়ে, সেখানকার সিস্টেম মানুষজনের সাথে তিনি ঠিক কেমন অভিজ্ঞতার সম্মূখীন হয়েছেন এবং একই ভাবে যখন দেশে ছিলেন তখন সেই ব্যাপারগুলো আমাদের দেশের মানুষের ব্যাপারে কেমন করে ঘটতো সেটার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। এতে করে পাঠকদের ব্যাপারগুলো বুঝতে আরও সময় হয়। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে কিংবা যে কোন কাজে সরকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়েছে তারা যেন ব্যাপারগুলো আরও ভাল করেই বুঝতে পারবেন। 

বই নিয়ে লেখা আর খুব বেশি লম্বা করছি না। বইটা আপনারা সংগ্রহ করে পড়ে নিতে পারেন। চৈতন্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে। পাবেন রকমারীতেই। এই বইটা একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। তখন লেখক সবে মাত্র গিয়ে হাজির হয়েছেন। প্রথমদিন ক্লাস করছেন। তিন ঘন্টার ক্লাস । মাঝে পনের মিনিটের একটা ব্রেক। সেদিনও তিনি রোজা রেখেছেন। ব্রেকের সময় সবাই বের হয়ে গেলেও তিনি ক্লাসেই বসে রইলেন। একেবারে নতুন। কিছুই চিনেন না । তাই এদিক সেদিক বিভ্রান্ত হয়ে হেটে বেড়িয়ে নিজের এনার্জি নষ্ট করতে চাইলেন না। তখন একজন মেয়ে তার কাছে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিল। মুসলিম । সে জানাল যে প্রফেসর যখন নাম পড়ছিল তখনই সে নাম তার শুনেছে আর বুঝেছে যে সে মুসলিম। তার কাছে জানতে চাইল যে সে রোজা রেখেছে কিনা। যখন তিনি বললেন যে তিনি রোজা তখন তাকে হ্যাপি রামাদান জানাল মেয়েটি। তারপরই তাকে স্ন্যাক্স আর কফির কথা জানাল । লেখক সেদিন তার জীবনের সব বিদ্ঘুটে আর কফিটা খেয়েছিল। এই ছোট ঘটনা পড়ে আমার মনে হল যে জীবনটা যদি অপু তানভীরের গল্পের মত হত তাহলে এই মেয়েটার সাথেই লেখকের একটা প্রেম হয়ে যেত। তখনই মনে মনে ঠিক করে নিলাম এই ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লেখার চেষ্টা নিব।





আমেরিকার দিনগুলি 
খন্দকার নাইমুল ইসলাম 
বইটা কিনতে রকমারি লিংক।