গত কয়েক দিনে হারুকি মুরাকামির একটা লম্বা পরিসরের উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। ইংরেজি কোন বই এতো দ্রুত আমি এর আগে পড়ি নি বা পড়তে পারি নি। দ্যা সিটি এন্ড ইটস আনসার্টেন ওয়াল। প্রায় পাঁচশ পাতার কাছাকাছি এই বইটা পড়তে আমার মূলত সময় লেগেছে তিন দিন। এতো দ্রুত যে পড়তে পারব সেটা আমি নিজেও ভাবি নি। তবে এক বার যখন বইয়ের ভেততে ঢুকে যাওয়া যায় তখন আসলে সময় জ্ঞান থাকে না। তখন বইয়ের জগতটাকেই আসল জগত মনে হয়।
এই গল্পটা বড় অদ্ভুত সুন্দর। তবে গল্পটার এক পর্যায়ে এসে আমার যেন মনে হচ্ছিল যে আমার নিজের চরিত্রের সাথে গল্পের প্রধান চরিত্রের অনেকটাই মিল রয়েছে। বিশেষ করে আমি যেমন করে ভাবি যেমন করে চিন্তা করি বড় অদ্ভুত ভাবেই গল্পের নায়ক তেমন করেই ভাবছিল।
গল্পের শুরুটা হয় টিনেজ বয়সের প্রেম থেকে। ১৭ বছরের এক ছেলে বছরের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে। তখনকার দিনে আজকের মত এতো ইন্টারনেট ছিল না। তাই তাদের কথা হত টিঠির মাধ্যমে। তারা চিঠি দিয়ে একে অন্যের সাথে কথা বলত। মাসে এক কি দুইবার দেখা করত। সেই দেখা করার ভেতরেও শুধু তারা কথাই বলত। দুজন দুজনকে একেবারে উন্মুক্ত করে তুলে ধরত। মেয়েটিই তখন ছেলেটিকে সেই অদ্ভুত শহরের কথা জানায়। এমন এক শহর যেখানে মেয়েটির আসল সত্ত্বা রয়েছে। সেই শহরটা বিশাল বড় এক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেখানে প্রবেশ করতে হলে নিজের ছায়াকে বাদ দিয়ে তারপর প্রবেশ করতে হয়। মেয়েটির আসল সত্ত্বা আসলে সেখানেই থাকে। এখন যেটা রয়েছে সেটা হচ্ছে মেয়েটির ফেলে যাওয়া ছায়া। সেই শহরে মেয়েটি একটা লাইব্রেরিতে কাজ করে। সেই লাইব্রেরিতে আবার কোন বই নেই। সেখানে রয়েছে মানুষের পুরানো স্বপ্ন। সেই লাইব্রেরি একজন ড্রিম রিডারের প্রয়োজন। মেয়েটি জানায় যে ছেলেটি এই ড্রিম রিডারের কাজ করতে পারবে যদি সে সেই শহরে গিয়ে হাজির হয়।
তারপর একদিন মেয়েটি ছেলেটির জীবন থেকে হারিয়ে যায়। বলা যায় একেবারে হাওয়াতে মিলিয়ে যায়। তার কোন খোজ আর পাওয়া যায় না। ছেলেটি তখন বুঝতে পারে যে মেয়েটি আবারও সেই দেওয়াল ঘেরা শহরে চলে গেছে।
জীবনের একটা লম্বা সময় ছেলেটা একলাই থাকে। আর কাউকেই যে ভালোবাসতে পারে না। চেষ্টা যে করে না সেটা তবে মেয়েটিকে সে যেভাবে ভালোবেসেছিল সেই ভালবাসা আর কাউকেই সে দিয়ে পারে না। পড়াশোনা শেষ কর একটা বুক ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীতে চাকরি নেয়। তার বয়স যখন ৪৪ তখন সে গিয়ে হাজির হয় সেই দেওয়াল ঘেরা শহরে। শহরের প্রবেশ পথে গেটকিপার তাকে জানায় যে এই শহরে প্রবেশ করতে হলে তার ছায়াকে নিজের থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। সে তাই করে। নিজের ছায়া আলাদা করেই সে শহরে প্রবেশ করে। তারপর সেই লাইব্রেরিতে গিয়ে হাজিয় হয়। সেখানেই সে দেখতে পায় তার সেই ১৬ বছরের প্রেমিকাকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তার বয়স ৪৪ হয়ে গেলেও তার প্রেমিকার বয়স সেই ১৬তেই আটকে আছে। তার মানে হচ্ছে এই শহরে যে যেই বয়সে প্রবেশ করে তার বয়স আর বাড়ে না। সেখানেই আটক থাকে। এই ১৬ বছরের প্রেমিকা কিন্তু তাকে চিনতে পারে না। কারণ যার সাথে ছেলেটির প্রেম ছিল সে ছিল এই মেয়েটির ছায়া। তবে এটাতে অবশ্য তার খুব একটা সমস্যা ছিল না। সে তার এই ভালোবাসার মানুষটির পাশে থাকতে পেরেই খুশি ছিল।
এদিকে তার থেকে আলাদা হয়ে তার ছায়ার অবস্থা ভাল ছিল না। শরীর থেকে আলাদা হলে ছায়ারা বেশিদিন বাঁচে না । আর একবার যখন কারো ছায়া মারা যায় তখন সে আর কখনই এই শহর থেকে ফিরে যেতে পারে না। তার ছায়াকে মৃত্যুর মুখে দেখে তখন ছায়াকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। শহরের এক পাশে নদীতে গিয়ে হাজির হয়। তবে শেষ মুহুর্তে সে পালানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। কেবল তার ছায়াকে পালাতে সাহায্য করে। ছায়া যখন পালিয়ে বের হয়ে আসে তখন সে নিজেকে আসলে আবিস্কার করে তার চিরায়িত জগতেই।
এই জগতে এসে সে আবার নিজের চিয়ায়িত জীবন শুরু করে । তবে এইবার সে আর আগের কাজ কর্মে মন বসাতে পারে না। সে চাকরি ছেড়ে দেয়। তারপর ছোট কোন শহরে একটা লাইব্রেরিতে চাকরি নিয়ে একেবারে নির্জন সেই শহরে বসবাস করতে চলে আসে। ছোট সেই শহরের স্থানীয় লাইব্রেরির হেড লাইব্রেরিয়ান হিসাবে জীবন শুরু করে।
এই শহরটাই তার জীবন আবার নতুন দিকে মোড় নেয়। কয়েকজন নতুন মানুষ তার জীবনে আসে যা অনেক কিছুর পরিবর্তন আনে। এই শহরে এসেই সে আবারও সেই দেওয়াল ঘেরা শহরের সন্ধান পায়।
বইটা শেষ করার পরে মনে ভেতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি এসে হাজির হল। অনেক দিন পরে কোনো বই পড়ে আমি এমন আনন্দ পেলাম ।