গোস্টরাইটার


 গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম মাইন। সে একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করত কিন্তু তার বস তাকে চাকরি থেকে বের করে দিয়েছে। খানিকটা বেকার হয়ে দিন পার করতে থাকে সে। শুরুতেই মাতাল হয়ে সে তার এই বসকে যাচ্ছেতাই বলে একটা ফেসবুকে পোস্ট করে।

সকালে যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন দেখে তার ব্যাংক একাউন্টে কেউ ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। তার এক্স-কলিগ তাকে জানায় যে টাকাটা এক ক্লায়েন্ট তাকে পাঠিয়েছে। কারণ তাকে একটা বই রি-রাইট করতে হবে। গোস্টরাইটিং প্রজেক্টের অগ্রিম পেমেন্ট। 

আসল পাণ্ডুলিপিটা লিখেছে আবরার ফাইয়াজ, একজন প্রাক্তন সরকারী আমলা। সরকারের বিরাগভাজন হয়ে ওএসডি অবস্থায় চাকরি থেকে অবসর নেন। তারপরই তিনি সরকারের সমালোচনা করে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। তার কলাম জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মেলায় লেখা তার একটা ননফিকশন বই বেস্ট সেলার হয়। তার কলামের চাহিদা বাড়তে থাকে। হঠাৎ আবরার ফাইয়াজের খেয়াল হল যে তিনি এবার ফিকশন লিখবেন। কিন্তু প্রথম যে ফিকশনটা লিখলেন তিনি সেটা একেবারে ডিজাস্টার হল । পরে আরেকটা উপন্যাস লিখে শেষ করলেন। সে বইটার প্রজেক্ট এসে হাজির হল মাইনের এক্স-কলিগ কাশফির হাতে। পাণ্ডুলিপিটা পড়ে কাফফি বুঝতে পারল যে বইয়ের প্লটটা দারুন । যদি ঠিক মত লেখা যায় তাহলে এই বই একটা বেস্ট সেলার হবে এবং সেই সাথে কোন পুরুস্কারও পেয়ে যেতে পারে। এখানেই ডাক করল পড়ল মাইনের। মাইন এখন সেই বইটা রিরাইট করবে।

মাইন প্রথমে একটু নিমরাজি হলেও পাণ্ডুলিপিটা পড়ার পরে এবং লেখকের সাথে কথা বলার পরে মাইন সিদ্ধান্ত নেয় যে সে কাজটা করবে। তবে শর্ত জুড়ে দেয় যে তাকে তার মত করে লিখতে দিতে হবে। সে পুরো বইটার থিমটা ঠিক রেখে সব কিছু ওলট-পালট করার স্বাধীনতা চায়। আবরার ফাইয়াজ আবার এতে প্রথমে না-খুশি হন । তিনি তখন মাইনকে আরেকটা প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটা হচ্ছে প্রথম দুইটা চ্যাপ্টারটা মাইনকে লিখতে হবে তার সামনে। তারপরে মাইন যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে লিখতে পারে । প্রথম দুই চ্যাপ্টার লিখতে মাইন লেখকের গাজীপুরের ফার্মহাউজে গিয়ে হাজির হয়। 

এই গল্পের আরেকটা চরিত্র হচ্ছে আরিয়া। ২১ বছরের তরুণী। আবরার ফাইয়াজের মেয়ে। সে তার বাবার সাথে থাকে। এই মেয়েটা অদ্ভুত এক গল্প শোনায় মাইনকে। গল্পটা একেবারেই বিশ্বাস করার মত না। কিন্তু মাইনের সেই অদ্ভুত গল্পটা বিশ্বাস হয়। সেটার পেছনে যথেষ্ট কারণও থাকে। মেয়েটার ভেতর অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আগে আগে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে, গল্প বানানোর অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। এবং মেয়েটার ছায়া পড়ে না। এটাও কি সম্ভব? কোন মানুষের ছায়া কি তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে? কিন্তু আরিয়ার ছায়া ওর সাথে নেই। যখন সে অদ্ভুত বইয়ের জগতে ঢুকেছিল সেখানেই সে তার ছায়াটাকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এদিকে মাইনও আবিস্কার করে তার নিজের ছায়া তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে । 

আর অন্য দিকে তাদের এই গোস্টরাইটিং প্রোজেক্ট খুব শক্তিশালী একটা মহলকে চিন্তিত করে তোলে। যে কোন ভাবেই হোক তারা চায় যেন এই বইটা না বের হোক। তার হাতে অসম্ভব ক্ষমতা! তাদের বিরুদ্ধচারণ করা মানেই হচ্ছে নিজের বিপদ ডেকে আনা ! তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। শেষ পর্যন্ত মাইন কী করবে? বই লেখা ছেড়ে দিবে নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে নাকি সব কিছু উপেক্ষা করে বইটা লিখে যাবে?

বইটা আমি পড়েছি তিনদিনে। তবে প্রথম পঞ্চাশটা পেইজ পড়তে আমার দুই দিন লেগেছে। তবে তারপরে যখন আস্তে আস্তে বইয়ের গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়লাম তখন আর উঠতে পারি নি। এক বসায় পড়ে শেষ করেছি। এক কথায় যদি বলি তাহলে বইটার প্লট দারুন। অনেক এমন একটা প্লটের বই পড়ি নি আমি। একই সাথে লেখকের কাহিনী বিন্যাসের ধরণটাও চমৎকার । তবে একটু বেশিই ডিটেইলিং করেছেন। আমার আবার এতো ডিটেলেইং পছন্দ না । অনেকের পছন্দ হতে পারে। কয়েক জায়গা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে এইসব স্থানে এতো বিস্তারিত লেখার কোন দরকার ছিল না। তবে বইয়ের সব থেকে অপছন্দের ব্যাপার হচ্ছে লেখকের ভাষা। বইটা প্রথম পুরুষে লেখা; সেই হিসাবে লেখক এটা চেষ্টা করেছেন একজন মানুষ ঠিক যেভাবে কথা বলে সেই ভাষাতেই সম্পূর্ণটা প্রকাশ করতে। এটা লেখক করেছেন সচেতন ভাবেই। কারণ অন্যান্য চরিত্র যখন কথা বলছিল তখন সেই ভাষা প্রমিত ছিল।

আমার কাছে ‘করতেছি, খাইতেছি, হইতেছে না, করি নাই’ টাইপের ভাষা পড়তে বড় অসহ্য লাগে। আর পুরো বইতেই এই ভাষা দিয়ে ভর্তি। এটা মূলত গল্পের চরিত্র মাইনের মুখের ভাষা। গল্পের চরিত্রের সংলাপের বেলাতে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করাটা অস্বাভাবিক মনে হয় না । কিন্তু যখন প্রথম পুরুষে বর্ণনা করা কোন গল্পে অন্যান্য সকল বর্ণনাও এই একই টাইপের ভাষায় বর্ণনা করা হয় তখন ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগত ভাবে বড় অপছন্দ । বইটার প্লটটা বড় ইন্টারেস্টিং ছিল বলেই আমি এই ভাষা ব্যাপারটা যথাসম্ভব এড়িয়ে বইটা পড়ে শেষ করেছি । নয়তো এই বই হয়তো আমার কোন দিন শেষ করা হত না। তবে আপনাদের যদি আমার মত সমস্যা না থাকে তাহলে অবশ্যই বইটা পড়ে শেষ করতে পারেন।

বইটা পড়ার সময়ে আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে এমন একটা বই বাতিঘর থেকে প্রকাশিত কেন হল! বাতিঘর যেমন বই প্রকাশ করে এই বইটা সেটার সাথে যায় না। তবে এবইয়ের একটা পর্যায়ে এসে কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট হল । আর এছাড়া বাতিঘরের মত অল্প কয়েকটা প্রকাশনী ছাড়া এমন বই বের করার কথাও না।

লেখকদের বলা হয় সমাজের দর্পণ । এই কথাটার বলার কারণ হচ্ছে লেখকরা সমাজে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা তাদের লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবেন যাতে করে আজ থেকে ৫০ কিংবা ১০০ বছর পরে যখন কেউ বইটা পড়তে তখন এই সময়ে সমাজে কী চলছিল, সেটার ব্যাপারে একটা ধারণ করতে পারে। আমাদের এই প্রজন্মের লেখকদের মাঝে এই ব্যাপারটা খুব একটা নেই। এই সময়ে দেখবেন খুব অল্প সংখ্যক বইতে আপনি বর্তমান সমাজের চিত্র পাবেন । আর ক্ষমতাসীনদের সমালোনা তো খুজেই পাবেন না। সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যে এমন একটা বই লেখক লিখতে পেরেছেন এই কারণে লেখক ধন্যবাদ !

সব মিলিয়ে গোস্ট রাইটার চমৎকার বই। পড়বেন অবশ্যই।


গোস্টরাইটার
আলভী আহমেদ
বাতিঘর থেকে প্রকাশিত