মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি ইতিহাস



সত্যি বলতে শুধু মাত্র একটা ফেসবুক পোস্ট কিংবা একটা ভিডিও দেখে ইতিহাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ এবং সঠিক জ্ঞান অর্জন করা কোন ভাবেই সম্ভব না। এমন কি কেবল ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করলেও একেবারে শতভাগ সঠিক ইতিহাস আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নাও হতে পারে। ইতিহাস যে লেখে তার নিজেস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময়ই ইতিহাসকে প্রভাবিত করে। 

আমাদের স্বাধীণতার আগের ইতিহাসের দিকে আমরা যদি খেয়াল করে দেখি তাহলে দেখবেন এটা নিয়ে মানুষের ভেতরে খুব একটা মতপার্থক্য নেই। তবে হ্যা, আমাদের আগের আওয়ামী সরকার যেভাবে স্কুল কলেজের বইতে শেখ মুজিবকে ঢুকিয়েছে সেটার কথা বলছি না। স্বাধীনতার ইরিহাস নিয়ে পড়াশোনা করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন । কিন্তু ৭২ থেকে শুরু করে ৮১ পর্যন্ত ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলেই আপনাদের মাথা ঘুরে যাবে। কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যা এটা মুঝতে ঘাম ঝড়বে । এই দশ বছরে এতো এতো ঘটনা ঘটেছে এতো জটিল সমীকরণ এই সময়ে লিখিত হয়েছে যে ১০ মিনিটের একটা ভিডিও কিংবা কয়েকটা ফেসবুক পোস্টে কোন ভাবেই এই সময়কার ইতিহাস সম্পর্কে জানা সম্ভব না। 

আরেকটা ব্যাপার আপনারা অনেকেই খেয়াল করে দেখবেন যে আমাদের দেশের ইতিহাস ৭১ এর স্বাধীণতা যুদ্ধের পরেই এসেই কেমন যেন থমকে যায়। এরপরের সময় নিয়ে মানুষ জন ঠিক কথা বলে না। বললেও কেমন লাফ দিয়ে দিয়ে যায়। একাত্তরের পরেই শেখ মুজিব রহমানের কারামুক্তি ও স্বদেশে ফেরত আসা। তারপর সেখান থেকে লাফ দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন । সেখান থেকে এক লাফে নির্বাচন। তারপর ৭৫ হত্যাকান্ড । কিন্তু এর ভেতরে যে আরও কত রকম ঘটনা রয়েছে তার কোন ঠিক নেই। 

আমি যখন প্রথম ঢাকায় আসি, নীল ক্ষেত থেকে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বাংলাদেশ রক্তের ঋণ বইটা পড়লাম । সময়টা সম্ভবত ছিল ২০০৯/১০। বইটা পড় সত্যি আমার মাথা ঘুরে গেল। এ যেন আমার কাছে একেবারে নতুন কিছু । এমন কিছু যে আমাদের দেশে হয়েছে সেটা আমার বিশ্বাসই হল না। এই লেখকের আরেকটা বইটা আমি পড়েছিলাম কলেজে থাকতে। বইটা আমাদের জেলা পাব্লিক লাইব্রেরিতে ছিল। সেখান থেকেই এই রক্তের ঋণ বইয়ের কথা জানতে পেরেছিলাম । কিন্তু সেটা লাইব্রেরিতে ছিল না । ঢাকায় এসে নীলক্ষেত থেকে প্রথমে এই বইটাই আমি খুজে বের করে কিনেছিলাম। এই বইটা পড়ার পরে আমার সেই স্বাধীণতা পরবর্তি সময়ের ঘটনা জানার জন্য আগ্রহ আরও তীব্র হল । একে একে আমি কতগুলো বই পড়েছি সেটার হিসাবও নেই। যত পড়েছি ততই আমার কাছে মনে হয়েছে যে এই সব বইয়ের লেখকরা কেউই শতভাগ নিরপেক্ষ নন, সেটা হওয়া সম্ভবও না। 

আমি নিচে একটা তালিকা দিচ্ছি । যাদের ঐ অস্থির সময়ের ঘটনা নিয়ে জানার আগ্রহ আছে তারা এই বইগুলো পড়ে দেখতে পারে। তবে একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। কোন লেখককেই শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না । সবাই যে সব কিছু একেবারে ধ্রুব সত্যি কথা লিখেছে সেটা মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে হবে। আপনি যখন পাঁচ সাতটা বই পড়ে শেষ করবেন তখন আপনার নিজের কাছে কোনটা সত্য আর কোন মিথ্যা সেটার একটা ধারণা চলে আসবে আপনা আপনি। এই ব্যাপারটা অন্যের ফেসবুক পোস্ট পড়ে কিংবা ১৫/২০ মিনিটের ভিডিও দেখে কখনই আসবে না। 

শুরুতেই কঠিন কিছু পড়তে বলছি না । আপনাদের সকলেই হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল পড়েছেন আশা করি । সেটা আর আলাদা ভাবে পড়তে বললাম না। দেয়ালের শেষের দিকে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বাংলাদেশ রক্তের ঋণ থেকে একেবারে হুবাহু তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে শুরু করবেন দুইটা উপন্যাস দিয়ে। 

১। সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ - সুহান রেজওয়ান

২। ক্রাচের কর্নেল - শাহাদুজ্জামান

এই দুইটা হচ্ছে উপন্যাস । এই দুটো উপন্যাস আগে পড়তে পারেন। এরপর পড়া শুরু করবেন ননফিকশন বইগুলো।

প্রথমেই পড়বেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বাংলাদেশঃ রক্তের ঋণ। বিদেশী লেখক মানেই যে একেবারে শতভাগ নিরোপেক্ষ লেখা সেটা আবার বিশ্বাস করবেন না । আগেই বলেছি কোন লেখকের বইই শতভাগ বিশুদ্ধ বলে ধরে নেওয়া যাবে না । তবে এই বইটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ । এরপর - 

১। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা - লেঃ কর্নেল এম এ হামিদ

২। মুলধারা ৭১ - মইদুল হাসান

৩। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ - প্রথম খণ্ড - পিনাকী ভট্টাচার্য

৪। জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি - মহিউদ্দিন আহমদ

৫। তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা -  শারমিন আহমদ

৬। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ - মহিউদ্দিন আহমদ

৭। বেলা-অবেলাঃ বাংলাদেশ ১৯৭২-১৯৭৫ -  মহিউদ্দিন আহমদ

৮। কাছে থেকে দেখা (১৯৭৩-১৯৭৫) - মে. জে. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান

৯। বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু এবং সিআইএ লিংক - বি জেড খসরু

১০। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশক (১৯৭১-১৯৮১) - মে. জে. মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) 

আগে এই কয়েকটা বই আপনারা পড়ে ফেলতে পারেন । এই বইগুলো পড়লে একটা ধারনা জন্মাবে আপনাদের মাঝে । এছাড়া আরো কয়েকটা বই আপনারা পড়তে পারেন । এই বইগুলো মনে হয় আমাদের সব বাংলাদেশীদেরই পড়া উচিৎ । একটা হচ্ছে মাওলানা আবুল কামাল আযাদের ‘ভারত স্বাধীন হল’, আকবর আলী খানের লেখা ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ এবং আবুল মুনসুর আহমেদের 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' । এই বইগুলো আমাদের দেশের আগের ইতিহাস সম্পর্কে আপনাদের একটা ধারণা দিতে পারবে। 

শুধু মাত্র ফেসবুক থেকে ইতিহাস জানতে যাবেন না । যদি সত্যিই আমাদের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে আপনার জানার আগ্রহ থাকে তাহলে নিজে বিস্তারিত ভাবে জানার চেষ্টা করুন। তবে এই বইগুলোই আসল কথা না । এটা সবেমাত্র শুরু। এই বইগুলো শেষ করলে কেবল মাত্র একটা ধারণা জন্মাবে যে আসলেই ঐ সময়ে আমাদের দেশে কী হয়েছিল কেন হয়েছিল। তবে আগেই বলেছি যে ইতিহাস আসলে কেউ শতভাগ সঠিক ভাবে লেখে না। যতই নিজেকে নিরোপেক্ষ ভাবে উপস্থাপন করুক না কেন সবার ভেতরেই একটা বায়াসনেস থাকবেই।   

এই বইগুলোর অনেকগুলোই আপনারা অনলাইনে খুজে পাবেন । সেখান থেকে নামিয়ে পড়তে পারেন যদিও আমি পিডিএফ পড়ার ব্যাপারে সব সময়ই নিরুৎসাহি করি। এই ১৫টা বই কিনতে কম করে হলেও সাট আট হাজার টাকা আপনাদের খরচ হয়ে যাবে। একটা সংগ্রহ শালার খোজ দিতে পারে যেখানে বেশ কিছু আগে থেকেই আপ্লোড করা রয়েছে। গুগল ফোল্ডার এ পাবেন কিছু বই।