লেখাজোকা সংকলন (পাঠ-প্রতিক্রিয়া)


আমি মূলত ছোট গল্পের পাঠক । অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে ছোট গল্প পড়তে আমার বেশি ভাল লাগে । বই মেলা থেকে বই কেনার ক্ষেত্রে এই বই গুলো কেনার দিকে আগ্রহ বেশি থাকে । আর পরিচিত লেখকদের বই হলে তো কথাই নেই । লেখাজোকা সংকলন বইটা কেনা হয়েছে বছর দুয়েক আগেই । তবে এতোদিন অন্য সব বই আর কাজের কারণে বইটা পড়া হয় নি । গতকালকে পড়া শেষ করে মনে হল যে বইটা আরও আগে পড়ে শেষ করা দরকার ছিল । 



বইয়ের ভেতরে অনেক কিছু রয়েছে ভ্রমন, কবিতা, গল্প স্মৃতি ফিচার । কবিদের কাছে আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । কবিতা আমি কম বুঝি । তাই কবিতা নিয়ে মন্তব্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না কোন ভাবেই । সেই বিষয়ে কোন কথা বলা ঠিকও হবে না । এখানে মূলত বইয়ের ভেতরে লেখা গল্প গুলো নিয়ে কয়েকটা কথা বলব । 

নেয়ামুল নাহিদের লেখা জরথ্রুস্টবাদঃ ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের একটি প্রাচীন একেশ্বরবাদ ধর্ম
জরথ্রুস্টবাদের উত্থান ঘটেছিল প্রায় তিন হাজার বছর আগে ইরানে । এই ধর্মের বলা হয়েছে, সর্বশক্তিমান একদিন লক্ষ্য করলেন যে এই পৃথিবী অশুভ শক্তির দখলে চলে গেছে । তিনি ভাবলেন এই পৃথিবীতে একজন ত্রান কর্তা প্রেরণ করা দরকার । যখন সকল ফেরেস্তা তাদের অপারগতা প্রকাশ করলেন তখন ঈশ্বর স্বয়ং সেই আত্মার নামকরণ করলেন জরোঅস্টার এবং তাকে পৃথিবীর ত্রাণ কর্তা হিসাবে পাঠালেন । মূলত এই প্রাচীন ধর্ম নিয়ে আরও খুটিনাটি ব্যাপার গুলো লেখা হয়েছে ফিচারে । 

এরপরের ফিচারটির নাম ফিবোনাচ্চি সিরিজ এবং সোনালী অনুপাত। লেখক শাহানা ইয়াসমিন ।
ছায়াপথ থেকে শুরু করে হারিকেন অথবা শাকুম আমাদের কর্ণকুণ্ডলী সব কিছুর আকারের ভেতরে একটা মিল রয়েছে । এই কুণ্ডলী গুলো এক অদ্ভুত গানিতিক নিয়ম মেনে চলে । প্রাচীন কাল থেকেই ভাস্কর আর স্থপতিরা এক বিশেষ অনুপাত মেনে চলে । এটাকে বলে সোনালী অনুপাতা । পুরো ফিচার জুড়ে নানান এই অনুপাতের বিষয়ে লেখা হয়েছে । এই ব্যাপারটা আগে অল্প করে শুনেছিলাম । ফিচারে আরও চমৎকার ভাবে জানা গেল । 

গল্প অবয়ব । লেখক স. আ. নেওয়াজ 
দুর্যোগপূর্ন আবহাওয়ার ভেতরে প্লেনে করে গল্পের কথক দেশে ফিরছে । সেই প্লেনের অবস্থা খানিকটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । পরে প্লেন ল্যান্ড করলো দেশে কিন্তু .... আসলেই কি ল্যান্ড করেছিলো?
গল্পটা পড়ে মনের ভেতরে এতো নাড়া দিল । গল্পের কাহিনীই সম্ভবত এমন ছিল । একটা ব্যকুলতা এসে ভর করলো মনে ! 

গল্প সোনালী বালির প্রাচীর । লেখক আখেনাটেন 
বইয়ের ভেতরে সব থেকে পছন্দের গল্প। গল্পের শুরুর সামান্য ঘটনাটা শেষের দিকে দিকে এমন ভাবে মোড় নিবে আমি ভাবতে পারি নি । বুদ্ধিদীপ্ত লেখা । অনেক দিন পরে চমৎকার একটা গল্প পড়া হল ! 

গল্প রাঢ়াঙ । লেখক অগ্নি সারথি
সাওতাল নিঃসঙ্গ রমনী সাবিত্রী মরমুর গল্প । তার জীবন ভর ছিল কষ্ট আর সংগ্রাম । সাওতাল নারীদের পাড়ার বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই কেবল একটা দিন ছাড়া । সেই একদিনে সাবিত্রী মরমু বের হয় মহাজনদের ধান মাড়াইয়ের পরে ধান কুড়াতে । কিন্তু সত্যিই কি ধান কুড়ানো শেষ করে সাবিত্রী মরমুর ফেরা হয় আবার সাওতাল পাড়াতে !!

গল্প জুঁই । লেখক সামিয়া ইতি
জুঁই গল্পটা পড়ে আমি বেশ চমৎকৃত হয়েছি । গল্পটা যে এই দিকে যাবে সেটা ভাবতেও পারি নি । গল্প পড়ার মনে হল সত্যিই কি এমন কিছু আছে ? আমি যে কত মানুষের সাথে ইনবক্সে কথা বলেছি তাদের ভেতরে কি জুঁইয়ের মত কেউ ছিল কোন দিন ?
কী জানি ! থাকতেও পারে ।

গল্প হারানো ভালবাসা । লেখক সৈয়দ তারেক মাহমুদ 
কিশোর বয়সের প্রেমের গল্প । শুভ নামের ছেলেটা কিভাবে নতুন প্রেমে পড়ে তারপর কিভাবে প্রেম হারিয়ে যায় সেই গল্প । গল্পটা পড়ার সময় আমার মনে হল যেন আমি যেন চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি । ঠিক এমন ভাবে প্রেম করা আমাদের কিশোর জীবনে ঘটেছিলো । তখন এমন ফোন ছিল না, ছিল না ইন্টারনেট । চিঠির যুগের ভালোবাসা ! আহা !

গল্প পারফিউম এবং কাঠ পেন্সিলের গল্প। লেখক শামীম সাগর 
ঘুম থেকে অফিস যাওয়ার পথে গল্পের কথকের সাথে এক মেয়ের দেখা হয় বাসে । তার পাশে বসে মেয়েটি । গায়ে তার পারফিউমের গন্ধ । একসময়ে আবারও চলে যাওয়া । তবে গল্পটা পড়ে মনে হল যে লেখক বাস্তবতার চেয়ে কল্পনা মিশিয়েছেন বেশি । যেমন ঢাকার লোকাল বাসে ফাঁকা সিটে বসতে কেউ পাশের সিটের কাছে জিজ্ঞেস করে না । এই অংশ টুকু বাদ দিয়ে গল্পটা গত আরও চমৎকার । 

গল্প এক ডলার ছাপ্পান্ন সেন্ট । লেখক সোহানী  
কঠিন এক বাস্তবতার গল্প । লিসা জন্ম থেকে দেখে আসছে তার মা কী নিদারুন কষ্ট করে টিকে আছে । মাকে একটু শান্তি দিতেই হয়তো ঘর ছেড়ে নিজের পথে চলে আসা । তারপর সেই একই অবস্থানে নিকেজে আবিস্কার করে । শেষ পর্যন্ত এই এক ডলার ছাপ্পান্ন সেন্ট কি লিসা জোগার করতে পেরেছিলো ? কেন দরকার ছিল তার সেটা?

গল্প ভালোবাসার জাল বুনেছি। লেখক শিখা রহমান 
মাঝে মাঝে কিছু গল্প পড়া শেষ করলে মন অদ্ভুত ভাবে খারাপ হয়ে যায় । আমি জানি বানানো গল্প তবুও গল্পের চরিত্রের জন্য মনে একটা বিষণ্ণতা এসে ভর করে । এই গল্পটাও ঠিক তেমন ! রণো আর বহ্নির গল্প । 

অনুগল্প সীমাবদ্ধতা । লেখক সুমন কর !
ছোট এক পাতার একটা গল্প অথচ গল্পের ভেতরের কথা টুকু কত বিশাল । আমি প্রায়ই ভাবি যদি সত্যিই পৃথিবীর সব থেকে বড় ধর্ম হত ভালোবাসা তাহলে কতই না ভাল হত । 

অনুগল্প কৃষ্ণ জল । লেখক মনিরা সুলতানা 
এই গল্পের থিমটাও সীমাবদ্ধতার মতই । মানব মনে একজনের জন্য ভালোবাসা জন্মে অথচ তার সামনে দেওয়াল হয়ে দাড়ায় সমাজ আর ধর্ম ! 

স্মৃতি দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায় রইলো না। লেখক কামরুন নাহার বীথি 
স্মৃতি কথার সাথে নিজের জীবনের খানিকটা মিল যেন খুজে পেলাম । যদিও আমার দাদা বাড়িতে যাওয়া হত না খুব একটা । আমার ছোট বেলার আনন্দের স্মৃতি সব নানা বাড়ি কেন্দ্রিক । স্কুল ছুটি হলেই ট্রেনে চেপে চলে আসা হত নানা বাড়ি । সেখানে আমার মামাতো খালাতো ভাই বোন মিলে কত আনন্দ করা হত । লেখিকাও এখানে নিজের জীবনে কাটানো সেই চমৎকার সময় গুলোর কথা বলেছেন ।

স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া প্রাণের কাবুলিওয়ালা । লেখক মিথী মারজান 
রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পটা অনেকের পড়া নিশ্চিত । সেই কাবুলিওয়ালা গল্প টা লেখিকার জীবনে বাস্তবে হয়ে যেন ফিরে আসে । তার এতো পছন্দের মানুষ একজন পরে আবার তার জীবনে আসে গল্পের মিনির মত লেখিকাও যেন তার সেই কাবুলিওয়ালাকে আর চিনতে পারে না । 

স্মৃতি বন্ধু তোমার চোখের ভাঁজে চিন্তা খেলা করে । লেখক নীলা নাজমা 
এক ফেসবুক ফ্রেন্ড রিকু থেকে বাস্তবে প্রানের বন্ধু হওয়ার গল্প । 

রম্য নিজে বাঁচলে দিগম্বর মামার নাম । লেখক গিয়াস উদ্দিন লিটন 
ঝনটু মামার প্রেমপত্র রিনাপুর কাছে পৌছে দিতে গিয়ে অপমান হয়ে ফিরে আসা । ঝনটু মামার মাথা গরম । তার ভাইগ্নাকে অপমান । এর প্রতিশোধ নিতেি হবে । কিন্তু প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ঝনটু মামা যে কী এক মহা বিপদে পড়লো ! মামার বিপদে পাঠকের দুঃখের চেয়ে বরং হাসিই বেশি আসবে । 

ভ্রমন ভিলা দি এসতে । লেখক আরিফ - উজ্জামান কাজল 
রোম শহরের একদম নিকট বর্তী একটা ছোট্ট শহরের নাম তিভলী । রোম থেকে মাত্র ২৬ কিমি দুরে অবস্থিত । এর শহরের অনেক গুলো দর্শনীয় স্থানের ভেতরে ৩ টি স্থান বিখ্যাত এবং এগুলো ওয়ার্ল হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। লেখক মূলত এই শহরে যাওয়া এবং ঘোরাঘুরির একটা বর্ণনা দিয়েছে । তবে ভ্রমন পোস্টটা আরও একটু ভাল লাগলো যদি কয়েকটা ছবি যুক্ত থাকতো । 

মোটামুটি এই হচ্ছে আমার পড়া বই । এছাড়া আরও কিছু পড়া হয়েছে বইয়ের ভেতরে তবে সেগুলোর ব্যাপার লিখলাম আর । বইটির প্রকাশা কাল ২০১৯ । সম্পাদনা করেছেন শায়মা হক এবং গিয়াস উদ্দিন লিটন ! প্রকাশিত হয়েছে এক রঙ্গা এক ঘুড়ির ব্যানারে । বইটা আশা করি অনেক ব্লগারই পড়েছেন । যারা পড়েন নি তাদের কে বলবো আজই সংগ্রহ করে পড়ে ফেলুন ! রকমারীতে এখনও তিন কপি আছে দেখা যাচ্ছে । পড়ে ফেলুন । সময় নষ্ট হবে না গ্যারান্টি দিতে পারি । 

হ্যাপি রিডিং