পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ অগল্প

অগল্প বইটা নিয়ে কী রিভিউ লিখবো সেটা বুঝতে পারছি না । আসলে এটাকে ঠিক উপন্যাস আমার মনে হয় নি । লেখিকা তার মেডিক্যাল শিক্ষা জীবনটাকে দুই মলাটের ফ্রেমে বাঁধার চেষ্টা করেছেন । অথবা অন্য ভাবে বললে লেখিকার মেডিক্যাল জীবনের দিনলিপি লিখেছেন । আমরা যেমন করে দিনলিপি লিখি, প্রতিদিন কী হল না হল, কে কি করলো কে কি বলল, বইটা পড়ার সময়েও আমার মনে হয়েছে যেন কোন হবু ডাক্তারের ডাইরি পড়ছি । বইয়ের ভেতরে অনেক গুলো গল্প লুকিয়ে

রয়েছে । আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে যেমন নানা রকম গল্প, নানা রকম ঘটনা ঘটে, এই বইয়ের কাহিনীও ঠিক সেই রকমই । গল্পের শুরু হয় জাহান যখন কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয় এবং গল্পের শেষ হয় যখন সে একেবারে ইন্টারনি করে শেষ । বইয়ের পুরো ঘটনা এই সময়টুকু নিয়ে । 

অগল্পের কাহিনীর বর্ণণা কোন ভাবে একভাবে দেওয়া সম্ভব না । আগেই বলেছি, পড়ার সময় আমার মনেই হয় নি যে এটা কোন একক কোন গল্প না, বরং একজন মানুষের জীবনের অনেক গুলো গল্পের সমষ্টি ।


গল্পের জাহান নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে । বাংলাদেশের অধিকাংশ নিন্মবিত্ত পরিবারের মতই । দুই বোন এক ভাই আর বাবা মা । মা গৃহিনী বাবা অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি । মেডিক্যালের পড়াশুনার জন্য বাসা থেকে পর্যাপ্ত পরিমান টাকা জাহানকে তার বাবা মা দিতে পারে না । জাহান নিজেই যতখানি পারে টিউশনী করে সেটা জোগার করে নেয় । 

গল্পের শুরুতে জাহানের সাথে বকুল নামের এক ছেলের পরিচয় হয় । সেও ডাক্তার হতে এসেছে । কিন্তু বকুল ডাক্তার হতে চায় নি । সে হতে চেয়েছিলো শিল্পী হতে । কিন্তু পরিবারের চাপে তাকে আসতে হয়েছে । জাহান সব সময় ক্লাসের সবার থেকে দুরে থেকেছে । কিন্তু বলুকের সাথে তার ভাব হয়ে যায় । বলুলের মেডিক্যালে মন নেই । জাহান তাকে বকা দিয়ে পড়া বুঝায় । তার সাথে ঘন্টার পর লাইব্রেরিতে কাটায় । এক সময় বলুক ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে প্যারিসে পাড়ি জমায় আর্ট শেখার জন্য । জাহান আবার একটা হয়ে যায় । মেডিক্যালের পুরো সময় জাহান সেই একলাই থাকে । তার সব কিছুতেই এক নিঃসঙ্গ ভাব । সবার মাঝে থেকেও যেন জাহান একলা । কার অপেক্ষাতে আছে সে? কার উপর অভিমান করে? বলুকের উপরে কি? নাকে ঘুসি মারার পর থেকেই বদরুদ্দোজা জাহানের প্রেমে পাগল । তাকে ছাড়া যেন কিছুই চোখে দেখে না । তাই যে রেহনুমার প্রেমকে কোন দিন বুঝতে পারে নি । বুঝতে পারলে হয়তো আজকে বদরুদ্দোজা আর রেহনুমার জীবনটা অন্য রকম হত । যদি জাহান অভিমানটা ভুলে বকুলের সাথে যোগাযোগ করতো তাহলে জাহানের জীবনটা কি অন্য রকম হত না? 


অগল্প পড়ার সময়ে আমার বারবার কেন জানি নিজের কথা মনে হয়েছে । একজন অতি সাধারন মানুষ যখন স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ঠিক যেভাবে চার পাশের পরিবেশটা দেখে, লেখিকা যেভাবে বর্ণনা করেছে, আমার সেটা পড়ার সময়ে মনে হচ্ছিলো আর এমন করে আমার শিক্ষা জীবনটাও কেটেছে, ঠিক জাহান যেভাবে কাটিয়েছে সেই ভাবে । এই জন্যই গল্পটা হয়তো মন ছুয়েছে । নিজের মত গল্প বলেই । গল্প শেষ বুকের মাঝে জাহানের জন্য একটা কষ্ট অনুভব হয়েছে তীব্র ভাবে । আসলে কষ্টটা হয়েছে নিজের জন্যই । বারবার মনে হয়েছে আহারে মেয়েটা এতো কষ্ট কেন করবে জীবনে ! অথবা নিজের কষ্ট গুলোকে আরও বেশি করে উপলব্ধি করেছি বলেই হয়তো গল্প পড়ে জাহানের জন্য কষ্ট অনুভব হয়েছে ।


আমি যদি মেডিক্যালে পড়তা তাহলে হয়তো এই গল্পটা আমার কাছে আরও বেশি ভাল লাগতো । একেবারে মেডিক্যাল জীবনের ফার্স্টহ্যান্ড অভিজ্ঞতার কথা এখানে লেখা । আমার কাছে মনে হয়েছে সেটা একটু বেশি স্থান নিয়ে নিয়েছে । আমি যেহেতু এই লাইনের লোক না তাই এটা আমার কাছে একটু কম ভাল লেগেছে । লেখিকার লেখার হাত চমৎকার । লেখায় যে বাড়তি মেদ নেই এটা সব থেকে চমৎকার একটা ব্যাপার আমার মনে হয়েছে। কারণ যদি তা থাকতো তাহলে বুঝি এই গল্প অতি বিরক্তি কর হয়ে উঠতো । অগল্প মোটেই তেমন নয়। 

বইয়ের প্রচ্ছদটা আমার কাছে বেশ মনে হয়েছে । একাকী নিঃসঙ্গ কেউ দাড়িয়ে । মেঘলা বিষণ্ণ আকাশের পানে চেয়ে আছে । কী ভাবছে কে জানে ! বইয়ের বাঁধা একেবারে সেরা বলবো না । তবে ভাল । পৃষ্ঠার মানও ভাল । বইতে প্রুফ ভাল ভাবে দেখা হয়েছে । আমার চোখে কোন ভুল চোখে পড়ে নি ।  


অগল্পের লেখিকা জাহান সুলতানা

বইটি প্রকাশিত হয়েছে সতীর্থ প্রকাশনা থেকে

মোট পাতার সংখ্যা ২০৪, মুদ্রিত মূল্য ৩৫০।