আমার কাছে সাহিত্যের সব থেকে পছন্দের শাখা হচ্ছে ছোট গল্প । ছোট ছোট গল্প গুলো কিভাবে যেন মনকে নাড়া দিয়ে যায়। এমন অনেকবার হয়েছে যে একেকটা গল্প পড়ে শেষ করেছি তারপর বইটা কিছু সময়ে বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে গল্পটার কথা ভেবেছি । সেই গল্পটার পরে চরিত্র গুলোর কী হবে সেটা ভেবেছি । সুখের গল্প হলে আনন্দিত হয়েছি কষ্টের গল্প হলে মন খারাপ করে থেকেছি । জীবন ও জীবিকার গল্প পড়তে গিয়েও কয়েকবার এমন হয়েছে যে আমি একটা গল্প পড়েছি তারপর বইটা বন্ধ করে বেশ কিছু সময়ে সেই গল্পের
চরিত্র নিয়ে ভেবেছি । গল্প পড়ার ক্ষেত্রে অনেকেই গল্পের অনেক সাহিত্য মান নিয়ে কথা বলে আরও কত গুরু গম্ভীর আলোচনা করে ।আমার ভেতরে এসবের বালাই নাই । আমি গল্প পড়ি কেবল মাত্র নিজের মনের আনন্দের জন্য । একটা গল্প পড়ে যদি আমার মনে হয় মন আরাম পেয়েছে তাহলেই সেটা আমার কাছে ভাল লেখা । অন্য কোন কিছু চিন্তা করার সময় নেই ।জীবন ও জীবিকার গল্পের বেশির ভাগ প্রেক্ষাপটই বিদেশ কেন্দ্রীক বিশেষ করে কানাডা কেন্দ্রীক । আমরা যখন গল্প লিখি তখন আমাদের লেখার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে আমাদের আসেপাশের পরিবেশ । লেখিকা যেহেতু কানাডাতে বসবাস করেন তার লেখায় কানাডার প্রেক্ষাপট আসবে এটাই স্বাভাবিক । প্রায় প্রতিটা গল্পের মাঝে লেখিকা কিছু ভয়ংকর দিক তুলে এনেছে । সুন্দর একটা ছবির পেছনেও একটা খারাপ দিক থাকতে পারে এমন দিক যা সবার চোখের আড়ালে থেকে যায় অথবা আমরা দেখেও না দেখার ভান করি, এই বইয়ের কয়েকটা গল্পে সেই দিক গুলো সচেতন এবং চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । তাই পড়ার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝেই একটা ধাক্কা খেতে হয়েছে । এটা অবশ্য ছোট গল্প এটা একটা বড় গুণ । অল্প কথায় বড় ধাক্কা দেওয়া !
জীবন ও জীবিকার গল্প বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন আমাদের সামু ব্লগের গুণী ব্লগার আহমেদ জী এস। প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। বইটির প্রকাশক নীল সাধু।
বইয়ের প্রথম গল্প পার্ভাট । পার্ভাট গল্পটা ব্রকলিন নামের এক টিনএজ মেয়ের । মেয়ের বাবা এবং মা দুজনে আলাদা হয়ে গেছে এবং নতুন সঙ্গী নিয়ে বসবাস করছে । বাবার কাছে থাকলেও প্রতি সামারে মায়ের কাছে বেড়াতে যায় এবং সেখানে গিয়ে সে ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতার স্বীকার হয় । নিজের আপন মায়ের আচরন দেখেই সে খানিকটা অবাক হয়ে যায় । সেখানে আর যাওয়া হয় না সামারে । কিন্তু তারও ইচ্ছে করে অন্যান্য বাচ্চাদের মত করে আনন্দ করতে । কিন্তু টাকা কোথায় ? ক্লাসে নতুন ছেলে বিলকে তার বেশ পছন্দ । কী পরিপাটি আর সুন্দর দেখতে । সেই বিলের সাথে সে কত স্বপ্ন দেখে । কিন্তু সেই স্বপ্ন কি পূরণ হয়? গল্পের শেষে একটা বিরাট ধাক্কা খেয়েছি আর বইটা বন্ধ করে ভেবেছি আহারে মেয়েটা !
দ্বিতীয় গল্প দ্বিচারিণী । গল্পটা বলা চলে প্রতারণার গল্প । আহনা, সোহেল আর রাসেল এই তিন চরিত্র । একজন অন্য জনের উপর বিশ্বাস করে তৃতীয় ব্যক্তির সাথে প্রতারণা করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন পরিনতির দিকে যায় ! এই গল্পটাকে আমি বইয়ের সব চেয়ে দুর্বল গল্প বলবো । গল্প পড়ার সময়ই আমার মনে হচ্ছিলো যে শেষে এমন কিছুই হবে ।
এরপরের গল্পের নাম আশ্রয় । নীরা নামে এক তরুণী গ্রাজুয়েশন করতে আসে কানাডাতে । তার প্রতিবেশী ৭৫ বয়স্ক জেসিকা থাকে । অসম বয়সী দুই নারীর বন্ধুত্ব । নীরা দেশে রেখে আসা মায়ের ভালোবাসার পরশ খুজে ফিরে জেসিকার মাঝে ।
একজন হাফ মানুষের গল্প । কেরানি জহির সাহেবের গল্প । সারা জীবন মনে করে এসেছেন যে পরিশ্রম করলেই বুঝি সাফল্য পাওয়া সম্ভব । কিন্তু চারিপাশে তিনি কেবল অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখেন যে তিনি কেবল পরিশ্রমই করে যাচ্ছেন আর এই পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে অন্য জন । তিনি কি পারবেন এই বেগার খাটুনির বলয় থেকে বের হতে? নাকি আবারও আগের মত অন্যের জন্য ফলবিনীন পরিশ্রম করে যাবেন ?
কনক্লিক্ট গল্পটা আমার আরেকটা পছন্দের গল্প । মা রাহেলা এবং মেয়ে রিয়ার মাঝে দ্বন্দ্ব । দেশ থেকে বিদেশ এসেও রাহেলার ইচ্ছে দেশের ঐহিত্য ধরে রাখতে । কিন্তু মেয়ে রিয়া তাতে নারাজ । তার কথা এখন এটাই তার দেশ । এই দেশে রীতি অনুযায়ী সে চলবে । মা সেটা হতে দিবে না । উপায় না দেখে রাহেলা ঠিক করে দেশের কোন ছেলের সাথে বিয়ে দিবে । বিয়ে দিলেই বুঝি এই সমস্যা সমাধান । অধিকাংশ বাঙালী মেন্টালিটি যেমন হয় ! শেষ পর্যন্ত রিয়াকে নিজের পছন্দমত ছেলের সাথে বিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো রাহেলা? এই গল্পটা ঠিক যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আমার একটা গল্প লেখার ইচ্ছে আছে । দেখি কোন একদিন লিখে ফেলব।
জলে ভাসা পদ্ম গল্পটা পড়ে আমার রাইসার জন্য মন খারাপই হয়েছে । মানুষ ভালোবেসে ভরশা করে একজনের উপরে তারপর কিভাবে সেই ভালোবাসার মানুষটা বদলে যায় । তার কুৎসিত দিকটা বের হয়ে আসে!
একটি প্রোফাইল পিক এবং একজন সরীকৃপ কমন থিমের উপর লেখা গল্প । অনলাইনে প্রেম ভালোবাসা করার আগে মানুষের যে সচেতন হওয়া উচিৎ বিশেষ করে কম বয়সী ছেলে মেয়েদের সেটা এই গল্প পড়ে বোঝা যায় । বাবা মায়েরও উচিৎ তার ছেলে মেয়েরা অনলাইনে কি করতে সেটার উপরে নজর রাখা, তাদের সচেতন করা !
একজন জরিনা বা কোন এক আকবরের স্ত্রী অন্যকে বিপদে ফেলতে যে গর্ত খোড়া হয় সেখানে যে নিজের ক্ষতি সেটা এই গল্পের কাহিনী।
এক টুকরো ভালোবাসা গল্পটা রোমেলা আর আশিকের গল্প । দুজন ৭ বছর আমেরিকাতে । দেশে ফিরবে । নিজের যথাসাধ্য দিয়ে সবার জন্য উপহার কিনে আনে কিন্তু তারপর কি ঘটে ? গভীর মমতা নিয়ে রোমেলা কে জড়িয়ে ধরে? গল্পের চরিত্রের এই রূপটা আমি নিজ চোখে দেখেছি মানুষের মাঝে । আপনি মানুষের জন্য যত যা কিছুই করেন না কেন তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না । তারা দেখবেও না এই টুকু করতে আপনার কত কষ্ট হয়েছে তারা কেবল দেখবে নিজের ভাল ভাবে পুরন হল কিনা ! অন্য দিকে যে মানুষটা আপনাকে ভালোবাসে তার সামান্য কিছু করলেই সে তীব্র ভাবে সেটা প্রকাশ করে !
যোদ্ধা স্বামী হারা এক নারী গল্প । একদল হায়েনার মাঝে থেকেও রাজিয়ে যে সমানে যুদ্ধ করে চলেছে প্রতিবাদ করে চলেছে যোদ্ধা তারই গল্প । আমাদের দেশের মেয়েদের মাঝে এই ব্যাপারটা প্রায় নেই বললেই চলে । তার প্রতি অন্যায় হচ্ছে তবুও প্রতিবাদ করতে ভয় পায়, মুখ বুঝে সহ্য করে । যতদিন না প্রতিবাদ হবে ততদিন অত্যাচার চলবে ।
মানুষ কিংবা অমানুষ অবসর নেওয়া টোফাজ্জল সাহেবের গল্প । তার দুই ছেলে থাকে দেশের বাইরে । স্ত্রী অসুস্থ । নিজেদের টাকা পয়সার অভাব নেই । অভাব কেবল কাছের মানুষের । এই দেশে এমন অসংখ্যা নিঃসঙ্গ বাবা মা রয়েছে । ছেলেরা নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত । অথচ বাবা মায়েরাও তো তাদের জীবনেরই অংশ !
সিদ্ধান্ত অত্যাচার সহ্য করা এক স্ত্রীর গল্প । সুমনা জীবন ভর কেবল চেষ্টা করে গেছে তার স্বামীর সংসারের একটা অংশ হতে কিন্তু এতো চেষ্টা এতো ত্যাগ স্বীকারের পরেও কি পারে সেই সংসারের অংশ হতে ? শেষে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় ।
পিশাচ গল্পটা আরও একটা পছন্দের গল্প । রাশিদা সারা জীবন কষ্ট করে এসে হঠাৎই একটু সুখের দেখা পায় । এতো লাভিং আর কেয়াটিং স্বামী পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে । কিন্তু সেই সুখ কি তার সহ্য হয়? কী এক বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা কি ঘুরাক্ষণেও টের পেয়েছিলো সে?
পাত্রী চাই গল্পটা আমার সব থেকে মজার গল্প মনে হয়েছে। এটা দিয়ে আমাদের দেশের ছেলেদের একটা অংশের চরিত্র খুব ভাল ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । এবং গল্পের শেষে একটা তৃপ্তির ঢেকুকর তুলেছি আমি । গল্প শেষ করে মনে হচ্ছি যাহ বেটা তোর একেবারে উচিৎ শিক্ষা হয়েছে ।
তবে লেখার নিয়ে আমার একটু অভিযোগ আছে । অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপারে । যে শব্দ গুলোর চমৎকার বাংলা প্রতিশব্দ রয়েছে সেগুলো ইংরেজি শব্দ বাক্যে ব্যবহার করাটা আমার পড়তে ভাল লাগে না । যেমন সবাইকে অর্থনৈতিক ভাবে সফল হতে হবে, এই বাক্যটাই যদি লেখা হয় সবাকে ফাইন্যানশিয়ালি সফল হতে হবে । শেষ বাক্যটা আমার কাছে ভুল মনে হয় । মনে হয় ইংরেজ শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক না । এরকম ইংরেজি শব্দের ব্যাপার আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি লেখাতে যা আমার একটু খারাপ লেগেছে । ইংরেজি শব্দের এই ব্যবহার বলতে কেবল গল্প বর্ণনার ক্ষেত্রে বুঝিয়েছি । কোন চরিত্র যখন কোন কথা বলে সেক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দ ব্যাপার ঠিক আছে !
মোট ১১১ পেইজের গল্পের বই । পেইজের মান বেশ ভাল । বাঁধাইও চমৎকার । বইটা পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না । আর যারা ছোট গল্প পড়তে পছন্দ করেন তারা অবশ্যই পড়ে দেখতে পারেন।
বইয়ের নাম জীবন ও জীবিকার গল্প
লেখিকা সোহানী
মোট পৃষ্ঠা ১১১ । মুদ্রিত মূল্য ২২০ টাকা
প্রকাশিত হয়েছে এক রঙা এক ঘুড়ি থেকে ।