পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ শেষ অধ্যায় নেই

একজন লেখক থ্রিলার লেখক হিসাবে তখনই ব্যর্থ হোন যখন তার পাঠক তার গল্পের প্রতিটি মোড় আগে থেকেই অনুমান করতে পারেন । আমার ''শেষ অধ্যায় নেই'' পড়তে গিয়ে ঠিক এই কথাটাই মনে হয়েছে । আজকে দুপুরে এসে হাজির হয়েছে বইটা । একটানা পড়ে শেষ করলাম । আগে গল্পের কাহিনী বলে নিই । এবং আগে থেকে একটু সাবধান করে দিই যে এই কাহিনী সংক্ষেপে আমি মোটামুটি সব ঘটনাই বর্ণনা করবো । তাই এ পোস্ট পড়লে আপনার কাহিনী পুরোপুরি জানা না হলেও প্রায় সব জানা হয়ে যাবে । এরপর হয়তো বই পড়ার আগ্রহ জন্মাবে না । 


গল্পের দুই মুল কেন্দ্র চরিত্র একজন হচ্ছে শফিক শাহরিয়ার । সে বিখ্যাত লেখক । তার বউ আছে, আট বছরের মেয়ে আছে । তার একজন প্রেমিকাও আছে । যাকে নিয়ে বাজারে অনেক রকম রসালো খবরও বিদ্যমান । এই বাড়াবাড়ির কারণে তার বউ নাজনীন তাকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে । এই নিয়ে লেখক সাহেব মানসিক ভাবে বেশ বিপর্যস্ত । এই কারণে তার ঘুম আসে না, রাতে কিছু লিখতে পারছেন না ।


লেখকের একজন পিতা সদৃশ প্রকাশক রয়েছে যে লেখকের প্রথম বই ছাপিয়েছিলো । এবং তার এই বিখ্যাত হয়ে ওঠার পেছনে সেই বৃদ্ধ প্রকাশকের বড় অবদান রয়েছে । লেখকের সাথে তার সম্পর্ক এখনও বেশ গভীর। এখন তার ছেলেরা প্রকাশনা সামলায় এবং শফিক শাহরিয়ারের বইয়ের কারণে তাদের সেই প্রকাশনা টিকে আছে । টিকে আছে সেই প্রকাশকের পরিবারও ।


আরও দুইজন প্রকাশক রয়েছে যারা শফিক শাহরিয়ারের পেছনে লেগে রয়েছে বই নেওয়ার জন্য । এদের দুইজন লেখকের সাথে এমন চুক্তি করতে ইচ্ছুক যাতে সামনের সব বই তাদের প্রকাশনা থেকে বের হয় । এছাড়াও আরেকজন প্রোজেযোক রয়েছে যে চায় লেখকের বই থেকে সিনেমা বানাতে । সম্ভব হলে বই প্রকাশের আগেই মুভি বানাতে ইচ্ছুক ।


প্রেমিকা তৃনা কে লেখক মশাই এড়িয়ে চলা শুরু করেছেন । কারণ তিনি নিজের সংসার বাঁচাতে মরিয়া । তবে তৃনার ব্যাপারে তিনি নিজেকে খানিকটা অপরাধী মনে করেন । তাই একটা চেষ্টা রয়েছে যাতে তৃনার পেছনে বেশ কিছু টাকা খরচ করে তাকে একটা ভাল পজিশনে পৌছে দেওয়া যায় । যদিও এটা গল্পে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া নেই । 


এখন লেখক মশাই তার এক বন্ধুর টিএস্টেটে গিয়ে হাজির হয় একটা রহস্য উপন্যাস লেখার জন্য । এটা হবে তার প্রথম রহস্য উপন্যাস । এটা নিয়ে সে আগে অনেক স্থানে কথা বার্তা বলেছে । তাই পাঠক মহলে এর আগ্রহ অনেক । সে হাজির হয় টিএস্টেসে । গেস্ট হাউজে বসে লেখা লেখি শুরু করে । তার গেস্ট হাউজের পরেই এস্টেটের সীমানা । সেখানে কিছু অংশ ভাঙ্গা । একদিন রাতে গীর্জার ঢং ঢং আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এবং সে জানালা দিয়ে খেয়াল করে যে সেই ভাঙ্গা অংশে আলো হাতে কয়েকজন মানুষ কি যেন করছে । তার সন্দেহ হয় । সে এটা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে । সে আবিস্কার করে যে প্রতিদিন গীর্জাতে ঢং ঢং বেজে ওঠে না আবার শহরের সব স্থানে বিদ্যুৎ না গেলেও চা বাগানে বিদ্যুৎ চলে যায় নির্দিষ্ট কোন রাতের নির্দিষ্ট কোন সময়ে এবং সেদিন প্রতিদিন কার মত জেনারেটর চালু হয়ে যায় না । পুরো বাগান থাকে অন্ধকারে ঢাকা থাকে । লেখক অনুসন্ধান পরে জানতে পারে যে এই চা বাগানে কিছু অবৈধ কাজ কারবার চলতেছে । এবং এর সাথে জড়িত রয়েছে কিছু মানুষ । একদিন নিজে চোখেই সে অনেক কিছু দেখতে পারে । 


এদিকে তার নিজের উপন্যাস লেখা প্রায় শেষ হয়ে যায় । কেবল শেষ অধ্যায়টা বাকি । সে পরিকল্পনা করে যে উপন্যাসের শেষ অধ্যায় লেখার আগে পরিচিত কিছু মানুষকে সে দাওয়াজ দিয়ে নিয়ে আসবে টিএস্টেটে । আড্ডা দিয়ে । সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয় । সবাই আসেও । তার স্ত্রী আসে এবং আসে তার প্রেমিকাও, যদিও প্রেমিকাকে দাওয়াত দেওয়া হয় নি । সেখানে দুজনের মুখোমুখি ঝামেলা হয় এবং সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় । 


তখন লেখক মশাই খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এবং রুমে গিয়ে ড্রিংক করে । অন্যান্য গেস্টরা যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে । সেই দিন ভোরে লেখক সাহেবকে গেস্ট রুমের পেছনে যে খাদ রয়েছে সেখানে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় । প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হয় মদ খেয়ে মাতাল হয়ে সে খাদ থেকে পড়ে গিয়েছে ।


এবার আশা যাক গল্পের আরেক প্রধান চরিত্র রেজা হক কথায় । তিনি লেখকের ভক্ত । তার প্রায় সব বই তার পড়া । লেখক এখানে আছেন জেনে আগে একদিন লেখকের সাথে কথাও হয়েছিলো । এবং লেখক মশাই তাকে চাবাগানে ঘটা অবৈধ বিষয়টা জানাতে গিয়েও জানান নি । পার্টিতে তাকেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলো তবে কাজের কারণে সে আসতে পারেন নি । রেজা হক তদন্ত শুরু করে এবং এক সময়ে খুজে বের করে ফেলে যে চা বাগানের চোরাকারবীর কাজ চলছে । এবং এর সাথে চাবাগানের কিছু পরিচিত মুখ জড়িত । কে কে জড়িত সেটা বললাম না । তাহলে হয়তো পড়ার আগ্রহ একদমই চলে যাবে । তাদেরকে জেরা করেই জানা যায় তারা রাতের বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো তখন লেখককে নিয়ে গিয়ে খাদ থেকে নিচে ফেলে দেয় । সময় তখন ভোর ৫টার কিছু বেশি বাজে। রহস্য যখন সমাধান করেই ফেলেছে তখন ওটোপসি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে লেখকের মৃত্যু পাহাড় থেকে পড়ে নয় বরং আরও রাত তিনটার দিকে হয়েছে এবং সেটা বিষক্রিয়ায় । অর্থ্যাৎ ঐ চোরাকারবারীরা একজন মৃতমানুষকে খাদে ফেলেছে ।


আবারও তদন্ত শুরু হয় । রেজা হক শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকা এসে কাজ শুরু করে। এবার সবাইকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয় । সবাইকে জেরা করা হয় । এক সময়ে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয় । এবং রেজা হককে কেস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় । রেজা হক আবারও শ্রীমঙ্গল  ফিরে যায় কিন্তু তার মানে শান্ত পায় না । কারণ আসল আসামী ধরা পড়ে নি । লেখকের শেস উপন্যাসটা এবার রেজা হক পরে ফেলে । সেই উপন্যাসটাও এক লেখকে কে নিয়ে । সেও একটা রহস্য উপন্যাস লিখতে শুরু করে এবং সেটা শেষ করার আগে খুন হন । কিন্তু শেষ অধ্যায় লেখার আগে লেখক তার স্ত্রীকে একটা চিঠি লিখে রেখে যায় সেখানে খুনী কে সেটা বলা থাকে । স্ত্রী সেটা বের করে ফেলে । রেজাও সেই উপন্যাস পরে সেই চিঠির অর্থ উদ্ধার করে । এবং এক সময়ে সে প্রমান পেয়ে যায় কে আসলে খুন টা করেছে ।


এই থ্রিলার পড়ে আমার অনুভূতি ।


সাদাত হোসাইনের প্রায় সব বই আমি পড়েছি । তার লেখার যে ব্যাপার আমার সব থেকে বেশি অপছন্দ সেটা হচ্ছে প্রয়োজনের বেশি বর্ণনা । তার বই বইয়ের ভেতরে রেজা সিরিজের প্রথম বই ছদ্মবেশটা আমার কাছে মোটামুটি ভাল লেগেছিলো কারণ সেটাতে অন্য বইয়ের মত এতো বর্ণনা ছিল না । এবং খুনটা কে করেছে কিভাবে ঐ বদ্ধ ঘরে লাশটা এল এটা জানার আগ্রহ ছিল কিন্তু এই বইতে আমার কেন জানি তেমন আগ্রহ জন্মায় নি । কারণ হিসাবে বলতে পারি প্রতিটি ঘটনা ঘটনা ঘটনার পরপরই আমার মনে হয়েছে এরপর কি হতে পারে এবং প্রতিবারই আমার অনুমান সত্য হয়েছে যা থ্রিলার পাঠকদের কাছে হতাশাজনক । এবং যখনই শফিক শাহরিয়ার খুন হোন সবার আগে আমার মনে ঠিক যে মানুষটার কথা মনে হয়েছে যে এখুনি হতে পারে দেখা গেছে সেই খুনি হয়েছে । এমন কি যখন চোরাকারবারীটা স্বীকার করেই নিয়েছিলো যে তারা পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে তখনও আমার মনে হয়েছে ওটোপসি রিপোর্টে দেখা যাবে লেখক আগেই মারা গেছে কিংবা অন্য কোন কারণে মারা গেছে । বই জুড়ে টানটান উত্তেজনা কিংবা গভীর রহস্যের কিছুই ছিল না । আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে অবশ্য যে বিষে লেখক মারা গেছে সেটার ব্যাপারে কিছু লেখার দরকার ছিল । একটু রিসার্চ করলেই হয়তো এমন কোন বিষের কথা জানা যেত । সেটা করা হয় নি । এটা আমার কাছে বইয়ের বড় একটা ত্রুটি মনে হয়েছে । রহস্য গল্পে কিভাবে মারা গেল কি অস্ত্র দিয়ে,  সেটা বর্ণনা কিংবা কোন বিষ হলে সেটা কেমন বিষ নাম কি কিভাবে কাজ করে এসব তথ্য গুলো যোগ করলে লেখাটা আরও বেশি বাস্তবধর্মী হয় । তবে এই বইটাতেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বার্তা লেখা নেই দেখে ভাল লাগলো । বইয়ের বাঁধাই আর কাগজের মান ভাল । তবে বইয়ের দাম আমার কাছে বেশি মনে হয়েছে । অন্তত আরও ৫০ টাকা কম হওয়ার দরকার ছিল ।


এই রিভিউ পড়েও যদি বই পড়তে ইচ্ছে হয় তাহলে পড়তে পারেন । সাদাত হোসাইনের লেখা হিসাবে পড়তে পারেন কিন্তু যদি একটা ভাল রহস্য উপন্যাসের আশা করেন তাহলে আপনাকে হতাশ হতে হবে । 


ম্যাগপাই মার্ডার পড়া শুরু করেছি । দেখা যাক কাহিনীর কতখানি মিল রয়েছে । কাল পরশু সেটার ব্যাপার লিখবো।