পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ ভাসানবাড়ি

 ভাসানবাড়ি প্রকাশিত হয়েছে এই বছরের শুরুর দিকে । কোলকাতা থেকে । লেখক সায়ক আমান । সায়ক আমান আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট । থাকেন ওপারবাংলাতে । তার লেখার ভক্ত আমি । অনেক দিন থেকেই । প্রথমে তার লেখার খোজ পাই ইউটিউবের এক চ্যানেল থেকে । গল্প লেখার সাথে সাথে তার গল্প শোনার দক্ষতাটা খুবই চমৎকার । যেখান থেকেই মূলত তার লেখার সাথে আমার পরিচয় । 


তারপর প্রথম বই ''তার চোখের তারায়' এবং দ্বিতীয় বই ''আরিন ও আদিম দেবতার উত্থান'' আমার পড়া হয়েছে । এবং লেখক আমাকে হতাশ করে নি । ভাসানবাড়ি তার তৃতীয় বই । 


বইয়ের কাভারে লেখাটা আগে দেখে নেওয়া যাক। সেখানে লেখা আছেঃ

ভাসানবাড়ি -- আজ থেকে দুশো বছর আগে এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর তৈরি এক রহস্যময় স্থাপত্য। তার আগে একটা পুকুর ছিল এখানে। গোটা গ্রামের লোক ঠাকুর বিসর্জন দিত তাতে। সেটাকে বলা হত ভাসানপুকুর, সেখান থেকে ভাসানবাড়ি। লোকে বলে সেই পুকুরটার আত্মা এই বাড়ির ভিতরেও সঞ্চারিত হয়েছে। এই বাড়িটাও মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অন্তিমের দিকে। ভাসানের দিকে... কিন্তু সত্যি অন্তিম বলে কিছু হয় কি? কে বলতে পারে মাটি গলে, রঙ উঠে গিয়ে নদীর অপরপ্রান্তে যখন খড়ের কাঠামোটা পৌছায়, তখন কেউ অপেক্ষা করে না তার জন্য? কেউ আবার নিজের মতো করে সাজিয়ে নেয় না তাকে? মরে যাবার আগে শশাঙ্কমোহন বলেছিলেন হ্যালির ধূমকেতুর মতো এই বাড়িতেও নির্দিষ্ট সময় পরে ফিরে ফিরে আসে কোনো মানুষ। কে সে? এ বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায় অচেনা আকাশ, সত্যি কি সময়ের নিয়ম মানে না বাড়িটা? কিন্তু কীভাবে? রহস্য আর সময়ের চাদর মুখে টেনে কাদের অপেক্ষায় থাকে ভাসান বাড়ি?  


বইয়ের কাহিনী সংক্ষেপ


বিরাজপুর নামক গ্রামে একটি ২০০ বছরের অট্টালিকায় উপস্থিত হল হৈমন্তী ঘোষ। বাড়ির নাম ভাসানবাড়ি। কোলকাতা থেকে বাড়ির আসল মালিকদের একজনের সাথে ভাব জমিয়ে হৈমন্তি এই বাড়িতে থাকার অনুমতি যোগার করে নিয়েছে । হেরিটেজ রিসার্চ সোসাইটির পক্ষ থেকে এই বাড়ির ইতিহাস ও ভূগোল নিয়ে গবেষণা করতে এসেছে সে, গল্পটা এমনই । কিন্তু একটু পরে বোঝা যায় সে এই বাড়িতে কিছু একটা খুঁজতে এসেছে। এই বাড়ি যিনি বানিয়েছিলেন, সেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাকি এখানে লুকিয়ে রেখে গেছেন এক অবিশ্বাস্য প্রযুক্তি। তা সময়ের গতি এলোমেলো করে দেয়। দেখায় অজানা আকাশে অচেনা তারাদের। এই বাড়ির ভেতরে স্বাভাবিক কোন নিয়ম খাটে না ।


এছাড়া হৈমন্তী নিজের দেহে বয়ে চলেছে এক মরণ ব্যাধি । তিলে তিলে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে । বইয়ের কিছু অংশ হৈমন্তীর অতীত জীবনের কিছু গল্প আছে । বাড়ির কেয়ার টেকারের ছেলে অশ্বিনীর ভেতরে অদ্ভুত কিছু আছে । সে বারবার হৈমন্তীকে অবাক করে দেয় তার কাজ কর্ম দিয়ে । বারবার হৈমন্তীকে রক্ষা করে চলে সকল বিপদ থেকে । কে এই অশ্বিনী ? সে আসলেই কেয়ারটেকারের ছেলে তো? ছেলেই যদি বলে তাহলে কেন কেয়ারটেকার অশ্বিনীর ভয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে?


এছাড়াও যারা হৈমন্তীকে পাঠিয়েছিলো সেই যন্ত্রটা নিয়ে আসার জন্য তারা কি ছেড়ে দিবে হৈমন্তীকে ? সেই সমস্ত লোকদের হাত থেকে কি অশ্বিনী হৈমন্তীকে রক্ষা করতে পারবে? আর কেন রক্ষা করবে? হৈমন্তীর সাথে অশ্বিনীর কি এমন সম্পর্ক? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বইতে । 


বইটাকে যে কোন ধরনের বই বলবো সেটা আমি নিজেও নিশ্চিত না । লেখক বইয়ের শুরুতেই বলেছেন সায়েন্স ফিকশন বলে তারা বইটাকে চালাতে চেষ্টা করবে ঠিকই কিন্তু আসলে এটা একটা ভালোবাসার গল্প । আমিও লেখকের সাথে একমত । বইটা আসলেই এক ভালোবাসার গল্প, অপেক্ষার গল্প । বইটা শেষ করে বেশ কিছু সময় আমি চুপচাপ বসে ছিলাম কেবল । কী তীব্র একটা অনুভূতি হয়েছিলো মনের ভেতরে সেটা কোন ভাবেই বুঝতে পারি নি । বইটাকে ভালভাবে প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয় বিশাল মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে এক অকল্পনীয় প্রেমকাহিনী এই ভাসানবাড়ি । জীবনে আপনি অনেক প্রেমের কাহিনী পড়েছেন কিন্তু এমন প্রেমের কাহিনী আপনি পড়েন নি । সামনে কোন দিন পড়বেনও না । 


বইটা নিঃসন্দেহে পড়তে পারেন । ২২৩ পেইজের বইটা পড়ে ফেলতে পারবেন এক বসাতেই । একবার গল্পের ভেতরে ঢুকে গেলে আর উঠতে পারবেন না আশা করি । কিন্তু সমস্যা যেটা হবে সেটা হচ্ছে বইটা সংগ্রহ করতে একটু ঝামেলা হবে । বইটা কোলকাটা থেকে প্রকাশিত হয়েছে । তাই এই দেশ থেকে সংগ্রহ করাটা একটু মুশকিল । কোন অনলাইন স্টোর কিংবা নীলক্ষেতে পাবেন বলে মনে হয় না । আমি বইটা কিনেছি ঢাকার বাতিঘর বুক স্টোর থেকে । ওরা নিয়মিত কোলকাতা থেকে বই নিয়ে আসে । লেখকের অন্য দুটো বইও পাবেন বাতিঘরেই ।