লভক্রফটিয়ান হরর: অদ্ভুত আঁধার এক

লভক্রফটিয়ান হরর সম্পর্কে এদেশের মানুষের খুব একটা ধারনা নেই । এই লভক্রফটিয়ান হররের সৃষ্টা হচ্ছেন জনপ্রিয় হাওয়ার্ড ফিলিপ লভক্রাকট । তিনি তার বিভিন্ন গল্পে এমন কিছু ভয়ের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে । আমাদের ধর্ম গ্রন্থ গুলো অনুসারে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের ভালবাসেন তিনি সব সময় আমাদের মঙ্গল চান কিন্তু লভক্রফটিয়ান হররে এই গডেরা আমাদের মানে মানুষদের মোটেই ভাল বাসে না । আমরা যেমন প্রতিদিন অসংখ্য মশা মাছি পোকা মাকড় মেড়ে ফেলি পিসে ফেলি পায়ের নিচে, তারা বাঁচলো কি মরলো আমাদের কিছু যায় আসে না এই লভক্রফটিয়ান হররের গডেরাও মানুষদেরকে ঠিক এমনই মনে করে । মানুষ বাঁচলো কি মরলো তাতে তাদের কিছু যায় না ।

আমি এর আগে লভক্রফটিয়ান হরর পড়েছি তা মুলত সব হাওয়ার্ড ফিলিপ লভক্রাকটই লেখা । তবে গত বছর কথুলহু নামে নামে একটা মৌলিক উপন্যাস পড়েছিলাম । লেখক ছিলেন আসিফ রুডলফাজ ! এই বছর আরেকটি লভক্রফটিয়ান হররের বই বেড়িয়েছে । তিন জন লেখকের মোট ছয়টা ছোট গল্প নিয়ে এই বই । বইয়ের নাম অদ্ভুত আঁধার এক। ভূমি প্রকাশ থেকে বের হয়েছে।
প্রথম গল্পটার নাম চুম্মা । গল্পের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে একজন পুলিশ অফিসারের বরাত দিয়ে । পনেরোটা খুন হয়েছে । সব একই কায়দায় । বিভৎস ভাবে । প্রথমে ভিক্টিমের চোখ জোড়া উপড়ে নেওয়া হয়েছে । তারপর বুক থেকে একেবারে নাভি পর্যন্ত চাকু দিয়ে চিরে ফেলা হয়েছে ।
পুলিশ অফিসার তার তদন্ত করার গল্প তার স্ত্রীকে শোনাতে থাকে । কিভাবে তারা প্রথম খুনির কাছে পৌছালো এবং তারপর আরও কয়েকজন কে খুজে পেল । এর একেবারে আসল স্থানে গিয়ে হাজির হল । কিন্তু সেখানে খুনির বদলে পেল অন্য কিছু । এমন কিছু যাতে তার সব কিছু বদলে গেল একেবারে ।
ছোট গল্পের রিভিও দেওয়ার উপায় নেই । তারপরেও এই কথা টুকু লিখলাম । এই হরের অন্য যে কোন হরের মত হলেও শেষে গিয়ে স্বাধটা বদলে যাবে অন্য ভাবে । আমার পড়তে ভালই লাগে । তবে অনেকের এই সব পছন্দ না । কয়েকটা বানান ভুল চোখে পড়েছে এই ছোট গল্পের ভেতরেই । অবশ্য আমার নিজের লেখায় প্রচুর ভুল থাকে তাই এটা নিয়ে অভিযোগ করা মানায় না আমার !
দ্বিতীয় গল্পের নাম আগমন । গল্পের শুরুতে বলা হয়েছে একজন গভীর ঘুমে আছেন । আর উনার স্বপ্নের মাঝেই আমাদের বিশ্ব জগৎ। উনি সব কিছু থেকে পুরানো । তিনি সেই শুরুর আগে থেকেই ঘুমিয়েই আছেন । তবে এক সময়ে তিনি জেগে উঠবেন এবং সেদিন নিজের স্বপ্নের মাঝেই প্রবেশ করবেন তিনি । আর নিজের সৃষ্টিদের সাথে দুঃস্বপ্নে মাধ্যমে দেখা দিবেন । আরও বলা হয়েছে যেদিন চরম পাপাচারের শিকার কোন সৃষ্টি নিজের অস্তিৃত্ব বিসর্জন দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকবে সেদিনই তিনি আসবেন ।
ঢাকার একটা ফ্ল্যাটে একটা মেয়ের সাথে পাপাচার হয় । রাজশাহীদে একজন অদ্ভুত কিছু শব্দ শুনতে পায় । টেক্সাসের এক মানসিক হাসপাতালে এক রাতে সব রোগীরা এক সাথে চিৎকার করে ওঠে । কানাডার ডা. ন্যান্সির কাছে কেউ অদ্ভুত ভাষায় লেখা একটা বই পাঠায় ! কি আছে সেই বইয়ের ভেতরে ? এভাবে একের পর এক সংকেত আর ইঙ্গিত দিতে থাকেন তিনি । তিনি আসছেন ! কেউ তাকে আহবান করেছে ।
শেষ পর্যন্ত কি তিনি আসবেন ? তারপর কি হবে ?
এই গল্পটা বেশ লম্বা তবে । আমার পড়তে বেশ ।
বইয়ের তৃতীয় গল্পের নাম যোগসাজশ । গল্পের নায়ক অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখে । স্বপ্নের ভেতরে সে দেখতে পায় সব কিছু ঠিকই আছে কেবল আকাশের বদলে মাথার উপর ফেলিন সমুদ্র । উচু উচু ঢেউ খেলছে সেখানে । কিছু সময়ের মধ্যে গোটা এলাকা ডুবে যাবে। প্রতিবার এই স্বপ্নের শেষে একটা শব্দ সে শুনতে পায় । যোগসাজশ।
মনকে শান্ত করতে গল্পের নায়ক রাহিক একা একাই ঘুরতে যায় বান্দরবান । সাথে থাকে গাইড মোর্শেদ । রেমাক্রিতে একদিন থাকার পরে সেখানে একটা পাহাড়ি মেয়ে মারা পড়ার খবর আসে । রাহিক ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ি এক বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে হাজির হল । সেখানে পুরোহিতের সাথে তার কথা হয় । পরের দিন যখন গাইডের সাথে সে ঘুরতে বের হয় তখন পাহাড়ি বনের ভেতরে আরেকটা মেয়ের লাশ খুজে পায় তারা । তারপরেই সেই ভয়ংকর ঘটনা শুরু হয় । যা কোন দিন ঘটে নি সেই ঘটনাটা শুরু হয়ে যায় । রাহিক আর তার গাইড প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি পালাতে পারে ?
এই গল্পটা পড়ে গিয়ে আমার মজাই লেগেছে । বান্দরবান কেন্দ্রিক সব গল্পই আমার পছন্দ । নিজে কয়েকবার এখানে গিয়েছি তার গল্প গুলো যেন আরও ভাল ভাবে আমি ওপভোগ করতে পারি ।
বইয়ের চতুর্থ গল্প অ্যাপোক্যালিন্স । ফারহান আর ইশরাত দুজন স্বামী স্ত্রী । একজন ডিবির পুলিশ অফিসার অন্যজন ডাক্তার । দুজনেরই পোস্টিং রাজশাহীতে । স্বামী স্ত্রীর ভেতরে দিন দিন একটা দুরত্ব তৈরি হচ্ছে । দুজন কেবল এক সাথে থাকছেই কিন্তু এর বেশি কিছু নয় । ইরশাত অনেকবাই ভেবেছে ফারহানকে ছেড়ে যাওয়ার কিন্তু যায় নি ।
ঘটনা শুরু হয় এক সকালে । ফারহানের ডিউটি নেই । সে হাটতে বের হয় টিবাঁধের দিকে । সেখানে গিয়ে একটা মৃতদেহ আবিস্কার করে । এক প্রফেসরের মানুষ নিজে মরে পড়ে আছে । তার শরীরের উপর একটা বাচ্চা অজ্ঞান হয়ে আছে । পরে বাচ্চা মেয়েটার কাছে জানা যায় যে লোকটা নিজেই আত্মহত্যা করেছে । এবং মেয়েটি একটা বিশাল আকৃতির জাহাজ দেখেছে । কিন্তু এই পদ্মায় জাহাজ আসবে কিভাবে । এর সাথে কি ফারহানের দেখা স্বপ্নের কোন যোগ আছে । সামনে গিয়ে অবশ্য সব কিছু জানা যাবে ।
এই গল্পটাও আমার কাছে বেশ ভালই লেগেছে । বিশেষ করে এই গল্পে যে কাহিনীর বিস্তার ঘটেছে সেটা আমার পছন্দ হয়েছে । রহস্যের সাথে সম্পর্কের টানা পোড়ন সব মিলিয়ে বেশ ।
পঞ্চম গল্পের নাম আঁধার আর ঈশ্বর । এই গল্পের শুরুতে বাবা মা তার মেয়ে জয়াকে ফেলে রেখে চলে যায় । কারণ তাদের বিশ্বাস যে তার মেয়ে অনেক বড় কিছুর কারনে সৃষ্টি হয়েছে । সে ঈশ্বর কে ডেকে আনার ক্ষমা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে । ডাস্টবিনের পাশে তাকে রেখে যাওয়ার পরে শহরের এক কৃতদার বড়লোক তাকে নিয়ে যায় বাসায় । সেই বড়লোক ব্যবসায়ী মানুষটিও তার নাম রাখে জয়া । উপর থেকে সবাই দেখে জয়া মানুষ হচ্ছে বিশাল বড়লোক এক ধনীর ঘরে কিন্তু ভেতরে জয়ার উপর এক নরক যন্ত্রনা নেমে আসে । সে এই কষ্ট থেকে মুক্তি চায় । একদিন সে ডাকবে ঈশ্বরকে মুক্তির জন্য । সেদিন কি সে আসবে ?
এই বইয়ের সব দুর্বল গল্প আমার কাছে এটাই মনে হয়েছে । অন্য সব গল্প গুলোতে যেভাবে কাহিনীর বিস্তার ঘটে সেই তুলনাতে এটা ছিল একেবারে সাদামাটা !
বইয়ের শেষ গল্প খুম । এই গল্পে উল্লেখ আছে জমদেবতা লিশ । গল্পে সজলের বন্দু নাতাশা । সজলের মন খারাপ । সে বিষণ্ণ হয়ে মন মরা হয়ে থাকে সব সময় । তার ভালবাসার মানুষটির সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে । নিজের ফেসবুকে সে প্রায়ই আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করে । এটা দেখে নাতাশার মনে অদ্ভত কষ্ট হয় । এই কষ্টের কথা সে সজলকে বলতে পারে না । নাতাশা সব সময় মারদাঙ্গা মুচ নিয়ে চলে । রাফ এন্ড টাফ মনভাব। এসব তাকে মানায় না । তবে মনে মনে সে সজলের কাছে থাকতে চায় ।
ওরা পাঁচ বন্ধুরা মিলে হাজির হয় বান্দরবানে । সেখানে ঘটনা ঘটে । জলদেবতা লিশের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে হয় । কিন্তু জলদেবতা তো এমনি এমনি প্রাণ ভিক্ষা দিবে না । তার প্রতিদানে কিছু দিতে হবে ।
এই গল্পটাও আমার বেশ পছন্দ হয়েছে । বলতে গেলে বইয়ের সব চেয়ে পছন্দের দুটো গল্পের ভেতরে এটা একটা । কাহিনী এগিয়ে গেছে খুব দ্রুত । কোথায় থেমে থাকে নি ।
এই মোট ছয়টা মৌলিক লভক্রাফটিয়ান হরর নিয়ে গল্প "অদ্ভুত আঁধার এক" আগেই বলেছি । যারা লভক্রফটিয়ান হরর সম্পর্কে জানেন এবং পছন্দ করেন তারা এই বই অবশ্যই সংগ্রহ করে পড়বেন । যারা জানেন না তাদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না । আগের কথুলহু একজনকে সাজেস্ট করেছিলাম । সে নাকি খুব হতাশ হয়েছে । তাই যারা লভক্রফটিয়ান হরর সম্পর্কে জানেন কিংবা পছন্দ করেন না তাদের কিছুই বলবো না !