পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ সমুদ্রের ডাক, বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা, রিটিন

প্রথম বইটার নাম সমুদ্রের ডাক । আহসান হাবীবের লেখা । সমুদ্রের ডাক বইটা ছোট । উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলাই ভাল । মাত্র ৭৫ পেইজের বই । ভেতরের কাহিনীও খুব বেশি বড় না ।
গল্পটা এক মিনিস্টারের । সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতাপে ভর্তি হয় । সেখানে গিয়াস নামের একজন সুদর্শন ডাক্তার আসে তার চিকিৎসা করার জন্য । খুব ছোট্ট একটা সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও মিনিস্টার সাহেবের অবস্থা দিন দিন খারাপ হাতে থাকে ।
ডা. গিয়াস ইচ্ছে করে মিনিস্টার সাহেবকে মেরে ফেলতে চায় । এর পেছনে অবশ্য যুক্তিসংগত কারণও থাকে । হাসপাতালের বেডে থাকা কালীন সময়েই ডাক্তার সাহেব মিনিস্টারকে তার জীবনের কুকীর্তির গল্প শোনাতে থাকে । সুদর্শন হওয়ার কারনে মিনিস্টারের মেয়ে ডাক্তারের প্রেমে পড়ে । মিনিস্টার কেবল চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে কিন্তু কিছু করতে পারে না ।
এক পর্যায়ে ডাক্তারের কাজ কর্ম ধরা পড়ে যায় । মিনিস্টার বেঁচে যায় এবং ডাক্তারকে জেলে পাঠানো হয় । কিন্তু মিনিস্টার কি আসলেই বেঁচে যেতে পারে ডাক্তারের হাত থেকে ? সেটা জানা যায় একেবারে শেষে । তবে শেষ পর্যায়ে গিয়ে কাহিনীর একটু ভাল ভাবে ফুটে উঠে । আসল একটা সত্য বের হয়ে যায় !

ছোট কাহিনী পরিসর হওয়ার কারনে বইটা আমার কাছে বেশ লেগেছে । বিশেষ করে শেষের টুকু পড়ে গল্পের ভেতরের একটা চমক সৃষ্টি হয়েছে সেটা কাহিনীকে আরও ভাল ভাবে পাঠকের মনে স্থান করে নিয়েছে । আহসান হাবীবের লেখা নিয়ে কোন কথা বলার নেই । তার লেখার সব থেকে পছন্দের দিকটা হচ্ছে খুব অল্প কথায় সে কাহিনী বর্ণনা করতে পারে । আমার কাছে এটাই কেন একজন লেখকের সব থেকে বড় গুণ মনে হয়ে । আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে সমুদ্রের ডাক লেখকের লেখা প্রথম উপন্যাস । সময় থাকলে পড়ে দেখতে পারেন । অনালইনেই ফ্রি পাবেন বইটা ।

পরের বইটার নাম "বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা" বইটার লেখক মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল । জাফর ইকবালের লেখা পড়া বাদ দিয়েছি অনেক আগেই । তার এখনকার লেখা আমাকে কেবল হতাশ করে । তবে এই বইটার প্রকাশ কাল অনেক আগে তাই কন্যার রিকোমেন্ডেশনে বইটা পড়া শুরু করলাম । পড়ার পর মনে হল আরে এই বইটা তো আমি আগেই এক সময় পড়েছি । আচ্ছা আরেকবার পড়া যাক !

বইটা মূলত পাঁচটা গল্পের একটা সংকলন । প্রথম গল্পটার নাম "বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা" । মূলত এই গল্পে অনিক লুম্বা নামটা কিভাবে আসলো সেটার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে । একটা বিজ্ঞানী সম্মেলনে লেখক যায় ভলান্টিয়ারের কাজের জন্য । একজন একজন বিজ্ঞানী আসছে তাদের নাম লিখে নেমপ্লেট দিয়ে দিচ্ছে সে । এমন সময় একজন এল । তার কাছে জানতে চাওয়া হল, আপনার নাম কি? সে বলল আমার নাম অনেক লম্বা । লেখক শুনলা অনিক লুম্বা । এখান থেকে অনিক লুম্বা নামের প্রচলন । দ্বিতীয় গল্পের না মশা । এই গল্পে অনিক লুম্বা মশা নিয়ে গবেষণা করে । এমন একটা ব্যাপার আবিস্কার করার চেষ্টা করে যেখানে মশা আর মানুষের রক্ত খাবে না । অন্য কিছু খাবে । এক সময় তার এই আবিস্কার ছিনতাই হয়ে যায় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছিনতাইকারী এই গবেষণা হজম করতে পারে ? সেটা দেখা যাবে গল্পের শেষে । তাররের গল্পের নাম ইদুর । এই গল্পে দুই মাস্তার এক বৃদ্ধার বাড়ি দখলের পায়তাড়া করে । বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা তার আবিস্কার দিয়ে তাদেরকে শায়েস্তা করে । "কবি কিংকর চৌধুরী" গল্পে এক কবি গিয়ে হাজির হয় লেখকের বোনের বাসায় । ভাগ্নে ভাগ্নীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এই কবির কারণে । লুম্বার একটা ঔষধ খাওয়ার কারনে কবির অবস্থা খারাপ হয়ে যায় । জলকন্যা গল্পে কেউ মাত্র কয়েকদিন বয়সের একটা বাচ্চা রেখে যায় লুম্বার বাসায় । তারপর এক সময় তারা আবিস্কার করে বাচ্চা পানির ভেতরে চমৎকার ভাবে সাতার কাটছে । পানির ভেতরে দারুন ভাবে শ্বাস নিচ্ছে ।
গল্প গুলো পড়তে আমার মজাই লেখেছে । হালকা মেজাজে পড়ার মত গল্প ।  সময় থাকলে পড়ে দেখতেই পারেন ।

এরপরের বইয়ে রাম রিটিন ! এটাও জাফর ইকবারের লেখা । এটা সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া লেখা । যদিও পড়ার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু কন্যার কথার অবাধ্য হওয়ার উপায় নেই ।

এই বইটা পড়ে আমি হতাশই হয়েছি । গল্পের কাহিনী আগে বলি । ভবিষ্যতের বিশ্বে সব মানুষের শরীরের একটা ট্র‌াকিওশান থাকবে । মূলত এটা হচ্ছে সেই মানুষটির যাবতীত তথ্য সম্বলিত একটা ডিভাইস যেটা তার শরীরের ভেতরে থাকে এবং এটার সাহায্য যে পৃথিবীর নানান কাজ করতে পারে । এটা অনেকটা আইডেন্টিটি কার্ডের মত । এটা শরীর থেকে বের হয়ে গেল সে দুনিয়া থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে । সে কোন কাজ করতে পারবে না । সেই পৃথিবীতে দুই শ্রেণীর মানুষ থাকবে । ক্যাটাগরি এ আর সি । এ ক্যাটাগরির মানুষদের বিশেষ ভাবে জন্ম দেওয়া । তাদের জেনেটিক কোড আগে থেকে সেট করে নিখুত ভাবে জন্ম দেওয়া হয় ! পড়ালেখা সুযোগ পায় সব ভাল ভাল চাকরি, সমাজের উচ্চ অবস্থান এদের জন্য । সি ক্যাটাগরির মানুষ এসবের সুযোগ নেই । তারা কেবল কাজ করে । রিটিন নামের ছেলেটা সি ক্যাটাগরির । তবে সে পড়ালেখা করতে চায় । সে একা একা অনেক কিছু শিখে নে্য । সে মেটাকোচ দিয়ে যে কোন রোবট কে অচল করে দিতে পারে । এমন ভাবে একটা রোবট কে অচল করে দেওয়ার জন্য তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় । তার মস্তিস্ক স্কেন করে দেখা হয় সে কোন অপরাধ করেছে কি না । কোন অপরাধ না পাওয়ার কারনে তাকে ছেড়ে দেওা হয় !
পরে সে বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত হয় । যেকোন ভাবেই হোক সমাজ থেকে এই শ্রেণী বৈষম্য দুর করতেই হবে । এটা করতে হলে ট্র‌াকিওশান সে তথ্য ভান্ডার আছে সেটা ধ্বংশ করতে হবে । সেটা ধ্বংশ করতে পারলেই সব বৈষম্য দুর হয়ে যাবে । কিন্তু সেই তথ্য ভান্ডার এমন একটা বিল্ডিংয়ে আছে যেটা কোন ভাবে ধ্বংশ করা সম্ভব না । এমন কি এই পৃথিবীটা ধ্বংশ হয়ে গেলেও সেটা ধ্বংশ হবে না এমন ভাবেই তৈরি করা হয়েছে । তাই ঠিক হয় রিটিনকে পাঠানো হবে অতীতে । অতীতে এমন একটা সময়ে গিয়ে সে হাজির হবে যখন এই ভবনটা তৈরি হয় । প্লান হচ্ছে সেই ভবনটা যেখানে তৈরি হবে ঠিক সেটার নিচে মাটির নিচে গিয়ে সে শীত নিদ্রায় চলে যাবে । তারপর একটা ভেতর থেকে উঠে ভেতর থেকে ধ্বংশ করে দিবে ।
অতীতে যখন সে ফিরে আসে তখন তার পরিচয় হয় তানুষ্কা নামের একটা মায়ের সাথে । তানুস্কার একটা চার বছরের ছেলে থাকে । তার স্বামী মারা গেছে আগে । রিটিন নীল রক্ষা করে এক দূর্ঘটনার হাত থেকে । এভাবেই তানুস্কার সাথে তার পরিচয় । তাদের বাসাতেই সে থাকতে শুরু করে । এবং একটা সময়ে ভবিষ্যৎ থেকে রিটিনকে হত্যা করতে রোবট পাঠনো হয় । সত্যিই কি শেষ পর্যন্ত রিটিন তার মিশনে সফল হয় ? নাকি তানুষ্কার সাথে নতুন জীবন শুরু করে ভবিষ্যতের সেই পৃথিবীর কথা ভুলে যায় !

এই গল্প আমাকে খুব বেশি আকর্ষিত করতে পারে নি । সায়েন্স ফিকশন হিসাবে এর কাহিনী খুবই কমন । বর্তমানের কোন থ্রেটকে অতীতে গিয়ে জন্মের আগেই ধ্বংশ করে দেওয়া দেওয়া যাতে সেটা আর নাই সৃষ্টি হতে পারে । গল্পে নতুন কিছু ছিল না আসলে । জাফর ইকবালের প্রায় প্রতিটা সায়েন্স ফিকশনে ভবিষ্যতের পৃথিবীর বিভিন্ন শ্রেনী কথা থাকে । এটা তার লেখার একটা কমন ব্যাপার। গল্পের একটা বিরাট ফাঁক রয়েছে । সে বিল্ডিং কোন নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ধ্বংশ করা সম্ভব না কেউ তার ভেতর থেকে বের হতে পারে না কিংবা ঢুকতে পারে রিটিন সেই বিল্ডিংয়ের নিচের মাটিতে গর্ত করে একটা ক্যাপস্যুরে শুয়ে ছিল এবং পরে এক সময়ে মাটি খুড়ে বের হয়ে এল ? যে বিল্ডিংয়ের দেওয়াল নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ভাঙ্গে না সেই বিল্ডিংয়ের মেঝে এতো সহজে কেটে বের হয়ে গেল ?

সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মুহাম্মাদ জাফর ইকবালের লেখার মান কমতেই আছে । এটা আরও কমবে । এই বই না পড়াই ভাল ! সময় নষ্ট কেবল ।