বুক রিভিউঃ ওই চাঁদ, তোমার আমার

দেশের সব থেকে জনপ্রিয় নায়ক এবং সফল ব্যবসায়ীর রিজওয়ানের বিয়ে । বিয়ের ঠিক আগ মুহুর্তে জানা গেল যে কনে পালিয়ে গেছে । চার হাজার অতিথি এসে হাজির । মিডিয়া হাজির । এখন যদি জানা যায় যে বিয়ের আগেই নায়কের বউ পালিয়ে গেছে তাহলে তার সামনের ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যাবে । তার রেপুটেশন একেবারে ধুলোয় মিশে যাবে ।

যার মেয়ে পালিয়ে গেছে সেও কম যায় না । ব্যারিস্টার এবং সরকারের তথ্যমন্ত্রী সে ! তারও গেস্টরা সব নামীদামী । এর ভেতরে আবার প্রাইম মিনিস্টারের ব্যক্তিগত সচিবও আছে !
এখন এই ঝামেলা থেকে কিভাবে পরিত্রান পাওয়া যায় ?
তখন ঠিক হল নির্ধারিত পাত্রী নয়, পাত্রীর ছোট বোনের সাথে নায়কের বিয়ে হবে ! বাবার মান সম্মান বাঁচাতে ছোট মেয়ে মেঘবতী বিয়েতে রাজি । রিজওয়ান মিডিয়ার বাইরের একজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো এবং চেয়েছিলো বিয়েটা বাবার পছন্দেই হোক । এমন কি সে পাত্রীকে না দেখেই পছন্দ করেছে কেবল মাত্র বাবার কথায় । পাত্রী বদলে গেলেও তার আসলে খুব একটা সমস্যা হল না । ঠিকঠাক মত বিয়ে হলেই হল ! তাদের বিয়ে হয়ে গেল ।
নায়ক রেজওয়ানের কর্মজীবন যেমন যে ড্রামায় ভরপুর ঠিক তেমনই তার বাস্তব জীবনেও শুরু হয়ে গেল আসল ড্রামা । বিয়ের দিন থেকেই তার জীবন একেবারে বদলে গেল । যেই রিজওয়ান কতশত সুন্দরী নায়িকাকে নিয়ে অনস্ক্রিনে কাজ করে, কাজের সময় কোন দিন তার অন্য রকম কিছু মনে হয় সেই রিজওয়ানের মেঘবতীকে প্রথম দেখে মাথা ঘুরে গেল । তার সব কিছুই উলটপালট হয়ে এল ।
তারপর থেকে সে নানান ভাবে মেঘবতীর কাছে আসতে চেষ্টা করলো কিন্তু মেঘবতীকে কে কিছুতেই বুঝতে পারলো না । মেঘবতী একেক সময় একেক আচরন করে । বারবার তার পরীক্ষা নিতে থাকে । সে শুদ্ধ পুরুষ খুজতে থাকে রিজওয়ানের মাঝে ! প্রতিবারই রিজওয়ানকে শুদ্ধ পুরুষ হওয়ার পরীক্ষা দিতে হয় । এবং প্রতিবারই সে পরীক্ষায় পাশও করতে থাকে কিন্তু তবুও মেঘবতী কাছে আসে না । মেঘবতী নিজেও নায়ক রিজওয়ানের জন্য পালগ কিন্তু বারবার সে নিজেকে তার কাছ থেকে দুরে রাখছে । মাঝে মাঝে পাগলামী করছে । ইচ্ছে হলে তার ঘরে চলে যাচ্ছে তাকে জড়িয়ে ধরে চলে আসছে কিন্তু রিজওয়ানকে পুরোপুরি কাছে আসতে দেয় না । কেন যে আসতে দেয় না সেটা একেবারে শেষের দিকে পাঠক জানতে পারে !
গল্পের প্রতিটা চরিত্রের যেন আলাদা একটা বৈশিষ্ট আছে । অনেক গল্পে কেবল একজন কিংবা দুইজন কিংবা দুজন প্রধান চরিত্র থাকে । এই প্রধান চরিত্রের সামনে বাকি সব চরিত্র গুলো কেমন ফিকে মনে হয় । মনে হয় এই ঘটনা বা এই দৃশ্যে এই চরিত্রটা না থাকলেও কিছু যেত এসতো না । কিন্তু "ওই চাঁদ, তোমার আমার" গল্পের প্রতি চরিত্রই যেন অপরিহার্য একটা অংশ । একটা কেও বাদ দেওয়ার কোন উপায় নেই । সব চরিত্রের আলাদা আলাদা গল্প আছে ।
প্রথম দিকে অনু চরিত্রের উপর তীব্র রাগ হচ্ছিলো । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো এই বেটি এমন করে কেন ? এমন করে মেঘবতীকে খোচা দিয়ে কথা বলতেছে কেন ! তারপর বুঝতে পারলাম যে আমাদের চারিপাশে এই রকম অনুর মত মানুষের অভাব নেই । তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে তার ভাইয়ের জন্য তার ভালবাসা এবং তার নিজের মাঝে এক শূন্যতার কষ্ট উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম । তখন তার উপর থেকে সব রাগ চলে গেল । রেজওয়ানের মা আর মেঘবতীর মায়দের চরিত্রের পরিস্ফুটন হয়েছে একেবারে চমৎকার । তারপর দুই বাবাদের কথা ! রিজওয়ানের বাবা ইরতাজুল করিম চৌধুরী আর মেঘবতীর বাবা সাবের হোসেন চৌধুরী । গল্পটা আমার কাছে এই দুই বাবার ভালবাসায় ভয়পুর মনে হয়েছে । সন্তানের প্রতি বাবার ভালবাসা এবং একই সাথে বাবার প্রতি সন্তানের ভালবাসা !
রিজওয়ান তার বাবাকে বলে, বাবা তুমি আমার হৃদপিন্ড । তুমি আমার জন্য যেটা পছন্দ করবে আমিও সেটাই পছন্দ করবো । কি চমৎকার একটা ! মেঘবতীর ক্ষেত্রেও একই কথা । সে তার বাবার সম্মানের জন্য এক কথায় রিজওয়ানকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় । সামনে গিয়ে আরও একটি বিশেষ কারন বেরিয়ে আছে !
তারপর রিজওয়ানের ম্যানেজার ইশতিয়াক তার মনবিজ্ঞানী বন্ধু মিজান আর অনু এসআই স্বামী চরিত্র গুলো যতবার সামনে এসেছে ততবার মুখে একটা হাসির রেখা দেখা দিয়েছে । বডিগার্ড রফিকের কথা গুলো যতবার আমি পড়েছি ততবার উচ্চস্বরে হেসে উঠেছি !
এই গল্পের সব থেকে ইন্টারেস্টিং চরিত্র হচ্ছে দাদী ! দাদীর প্রতিটি কথা যেন একেকটা গ্রেনেড ! প্রতিবার সে দৃশ্যপটে হাজির হয় এবং একেকটা বোমা নিক্ষেপ করে ! আর পাঠকদের উড়িয়ে দিয়ে চলে যায় !
মেঘার বন্ধু জুনায়েদের উপস্থিতি আমার মন খারাপ করিয়ে দিয়েছে । এর কারন হয়তো জুনায়েদের মাঝেই আমি খানিকটা নিজের ছায়া খুজে পেয়েছি । কাউকে তীব্র ভালবাসার এবং শেষে কপালের কারনে তাকে পাওয়া ! লেখিকা এখানে জুনায়েদ নামটা না ব্যবহার করে, তানভীর ব্যবহার করলে বেশ হত। জুনায়েদের দুটো কথা আমার খুব পছন্দ হয়েছে ।
"মেঘবতী এই পৃথিবীতে, এই পৃথিবীর একটা নিজস্ব নিয়ম আছে তুমি জানো ! সেই নিয়মের বাইরে গিয়ে কেউ কিছু করতে পারবে না । কে কি করবে, কি রকম থাকবে? সব এই নিয়মই ঠিক করে দেয় ! এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রন যার হাতে তিনি কঠিন ভাবে এই নিয়ম পালন করেন।"
তারপর জুনায়েদের আরেকটা কথা
"ভালবাসা খুবই দুষ্টু । এটা এর নিজের গতি ছাড়া আর কারও গতিতে চলে না বুঝলে? এর যখন যেখানে আসবার; আসে, থাকে, বিলীন হয় । এর শান্তি অশান্তি এ নিজেই ঠিক করে"
এই দুটো কথাই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ! একেবারে অন্তর থেকে ! গল্পে এটা জুনায়েদের মুখ থেকে বের হলেো আসলে এটা তো লেখিকার নিজের কথা । গল্পের মাঝে মাঝে এই রকম ছোট ছোট চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাটা খুব লেখকের মাঝেই আমি দেখেছি । এই চিন্তা গুলো একজন পাঠককে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করে । আমরা জানি যে এই গল্প বানানো, মিথ্যা, কল্পনা ছাড়া আর কিছু না কিন্তু এই চিন্তা গুলো মোটেই মিথ্যা না । এই চিন্তা গুলোই পাঠকদের জীবনে প্রভাব ফেলে, তার চিন্তায়, মন মানসিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করে ।

পুরো বইয়ের মাঝেই একটা ছন্দ বিদ্যমান ! একটার পর একটা লাইন যেভাবে আসছিলো, মনে হচ্ছিলো এটার পরে ঠিক এই লাইনটাই বসা উচিৎ, এই দৃশ্যের পরে এটাই হবে । কিন্তু একটা স্থানে এসে আমার কেন যেন মনে হয়েছে সেখানে খানিকটা সুর কেটে গেছে । বিজওয়ান যখন মেঘবতীর বন্ধু-বান্ধুবীদের সাথে দেখা করে, এই অধ্যায়টা পড়ার সময় আমার মনে হয়েছে বইয়ের বাকি লেখার সাথে এই লেখাটা যেন একটু আলাদা । যে ছন্দে পুরো বইটা লেখা হয়েছে কেবল এই অধ্যায়ে সেই ছন্দটা আমি পাই নি । পরের অধ্যায় থেকে আবার সব ঠিক !
গল্পের একেবারে শেষের দিকে আরেক কথা আমার এতো পছন্দ হয়ে বলে বোঝানো যাবে না ।
"আরে সব সময় কষ্ট দেওয়া মানেই তো শাস্তি নয় । মাঝে মাঝে গভীর ভালবাসাও মানুষের জন্য শাস্তি হয়।"
কি ভয়ানক সত্য কথা !
যারা এখনও পড়েন নি "ওই চাঁদ, তোমার আমার" তারা দ্রুত পড়ে ফেলুন ! পড়ে ফেলুন । মেঘা আর রিজওয়ানের জগৎ থেকে ঘুরে আসুন। এই ভ্রমন আপনার জীবনের অন্যতম আনন্দময় ভ্রমন হবে; নিশ্চিত করে বলছি !
বইয়ের নামঃ "ওই চাঁদ, তোমার আমার"
লেখিকাঃ তৃধা আনিকা
ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত