দ্য ডার্ক প্রিন্স (পর্ব তিন)

মিতুর জীবনটা হঠাৎ করেই বদলে গেছে । আগে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্লাসে যাওয়ার কথা ভাবতো, এখন ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার কথা ভাবে । ভাবে আজকে ক্লাসে যাবে নাকি অফিসে যাবে । যদিও ওকে অফিস থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে । ক্লাসের পরে অফিসে গেলে কোন সমস্যা নেই । 

মিতুর কাছে এখনও ব্যাপারটা স্বপ্নই মনে হয় । কিভাবে সেদিন চাকরিটা পেয়ে গেল । এমন ভাবে চাকরি পাওয়ার কোন কারন ছিল না । বারবার মনে হয় সেদিন যদি ও ৭০০ টাকা ফেরৎ দিতে না যেত তাহলে ওর জীবনে কি এই পরিবর্তনটা আসতো ? সবার কাছে হঠাৎ করেই এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারতো ?
ছোট বেলা থেকে মিতু একটা ব্যাপার বুঝতো খুব ভাল ভাবে । সেটা হল তোমার যদি টাকা না থাকে তাহলে জীবনে তুমি কোথাও দাম পাবে না । কেউ তোমাকে ঠিকভাবে দাম দিবে না । মিতুর জীবনটা এমন ভাবেই কেটে এসেছে ।
খুব যখন ছোট ওর বাবা কোথায় যেন হারিয়ে যায় কাউকে কিছু না বলে । তার আর কোণ খোজ পাওয়া যায় নি । সে মরে গিয়েছে সেটাও মিতু নিশ্চিত করে বলতে পারবে না । মিতু অবশ্য ওর নানা নানীর কাছে শুনেছে ওর বাবা মোটেই ভাল লোক ছিল না । ওর মায়ের সাথে বিয়েতে তাই তাদের কোন মত ছিল না । তবুও মিতুর মা তাকে বিয়ে করেছিল । কদিন সংসারও করেছিল । তারপরই গায়েব হয়ে যায় সে । আর কোন খোজ ছিল না ।
তারপর মিতুর মায়ের আবারও বিয়ে হয় । মিতুর বাবাকে মৃত ধরে নিয়ে খানিকটা জোর করেই বিয়ে দেয় তারা । আর মিতুর জায়গা হয় ওর নানার বাড়ি । এরপর সেখানে থেকে ওর বড় মামার বাসায়। ওর বড় মামাই ওকে একটু আদর করতো । মামার বাসা থেকে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় । ওর জীবনে কেবল লক্ষ্য ছিল অনেক টাকা পয়সা আয় করবে । সারা জীবন যেমন মানুষের আশ্রয়ে থেকেছে সেটা যেন ওর সন্তানের বেলাতে না হয় ।
কলেজ থেকেই মিতু টিউশনি করতো । চেষ্টা করতো অন্যের উপর নিজের নির্ভরতা কমাতে। যদিও ওর বড় মামা কখনই ওকে এই ব্যাপারে কিছু বলতো না । সে নিজের মেয়েদের মত করেই মিতুকে আদর করতো । মামীও মিতুকে ভালবাসতোই ।
কিন্তু মিতুর কাছে নিজেকে সব সময় কেমন অবাঞ্চিত মনে হত । বারবার মনে হত ও সবাই যেন ওকে অনুগ্রহ করছে, করুণা করছে । সেটা ওর কাছে সহ্য হত না ।
কিন্তু এই চাকরিটা পাওয়ার পরপরই সেই অনুভূতিটা কেমন করে যেন কমে গেল । সবার কাছে তো বটে মিতুর নিজের কাছেই নিজের একটা গুরুত্ব অনুভব করতে শুরু করলো । জীবনে হয়তো এই প্রথম ওর নিজের কাছেই মনে হতে শুরু করলো যে আসলেই মানুষ জন আর ওকে করুণার চোখে দেখছে না ।
-মিস মিতু !
নিজের ডেস্ক থেকে মাথা তুলে তাকালো । ফারাজ চৌধুরীর পিএ ওর সামনে এসে দাড়িয়েছে । মিতু বলল
-জি !
-আপনাকে স্যার ডাকছে ।
-এখনই ?
-হ্যা এখনই ।
মিতু হাতের কাজটা অসমাপ্ত রেখেই উঠে দাড়ালো । এই কয়দিনে এই অফিসে একটা ব্যাপার সে খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছে । সেটা হল ফারাজ চৌধুরীকে এরা সবাই জমের মত ভয় পায় । এই একটা ব্যাপার ছাড়া এই অফিসটা খুবই চমৎকার । সব থেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে এই বেতন স্কেল । প্রথমে মিতুর হাতে যখন প্রথম এপোয়েন্টমেট লেটার ধরিয়ে দেওয়া হল বেতনের পরিমানটা দেখে ওর চোখ কলাপে উঠেছিল । টাকায় পরিমান টা ওর মামার বেতন থেকেও বেশি। এতো টাকা সে মাস শেষ হলেই পেয়ে যাবে ! এটা কি সত্যিই হতে চলেছে ?
ওর চাকরি পাওয়ার কথাটা সে তাই কাউকেই বলেনি প্রথম কদিন । এমন কি আকাশকেও বলেনি এই চাকরি পাওয়ার কথা । নিজের ভেতরেই লুকিয়ে রেখেছিলো সব টুকু । ওর মনে এই ভয়টা ছিল যে হয়তো পরদিন অফিসে গিয়ে দেখবে তাকে আর অফিসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না । ওর দিকে তাকিয়ে সবাই হাসাহাসি করছে । ওকে বলা যাচ্ছে যে ওর সাথে একটা প্রাক্টিক্যাল জোক্স করা হয়েছে ।
কিন্তু পরদিন যখন অফিসে এসে যোগ দিলো তেমন কিছুই হল না । একে একে সবার সাথেই পরিচয় হল । সবাই নিজ থেকেই এসে ওর সাথে আলাপ করলো । ওর যেমন বিস্ময় ছিল এই চাকরি পাওয়াটা নিয়ে, অফিসের সবারও ঠিক একই রকম বিস্ময় কাজ করছিল । কারন ফারাজ চৌধুরী যা করেছে সেটা তার চরিত্রের সাথে ঠিক যায় না । তিনি কেন যে এই কাজটা করলেন সেটাও কেউ বলতে পারেন না । নানান জন নানান প্রশ্ন করলো ওকে । এই আগে থেকে ফারাজ স্যারের সাথে তার পরিচয় ছিল কি না, কিংবা অন্য কোন ভাবে কোন পরিচয় !
এক সপ্তাহ ঠিক মত অফিস করার পরে মিতুর মনে হল যে চাকরি টা সত্যিই সে পেয়ে গেছে। এখন সবাইকে বলা যায় ! মামাকে কথাটা বলতেই চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর আনন্দে জড়িয়ে ধরলো তাকে । ওর মামাতো দুইবোন মামী সবাই খুব খুশি হল। পরিচিত বন্ধু বান্ধব সবাই এই চাকরি পাওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলো । কিন্তু একটা মানুষ ঠিক খুশি হল না । সেটা হচ্ছে আকাশ ।
মিতু জানতো আকাশ এই চাকরির সংবাদ টা ঠিক ভাবে ভাবে নিবে না । আকাশের সাথে যখন ওর সম্পর্ক শুরু হয় তখন থেকেই মিতু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতে শুরু করে যে আকাশের মধ্য পুরুষতান্ত্রিক মনভাবটা খুব বেশি । মেয়েটা বাড়ির বাইরে গিয়ে চাকরি করবে এই ব্যাপাটা আকাশের ঠিক পছন্দ নয় । এই ব্যাপারটা নিয়ে আকাশের সাথে মিতুর মাঝে মাঝেই কথা কাটাকাটি হত । আকাশের মনভাব সে পরিস্কার বুঝতে পারতো যে বিয়ের পরে সে মিতুকে বাইরে চাকরি করতে দিবে না । এই একটা ব্যাপার বাদ দিলে আকাশের সব কিছুই মিতুর পছন্দ। এই সময়ে আকাশের মত কেয়ারিং একজন প্রেমিক পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার । মিতুর ধারনা ছিল যে একটা সময় ও আকাশকে ঠিকই মানিয়ে নিবে । সেই ভরশাতেই ছিল সে !
মিতু জানতো আকাশ ব্যাপারটা জেনে খুশি হবে না । মিতু যখন রাইড শেয়ারিং এপে সাইন আপ করেছিল তখনও আকাশ সেটাকে ভাল চোখে দেখে নি । তার চোখে তার প্রেমিকা অন্যকে পেছনে চড়িয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাবে সেটা তার ভাল লাগবে না । ওকে কড়া কন্ঠেই বলেছিল যে স্কুটি চালাও সেটাতে আকাশের কোন আপত্তি নেই কিন্তু কাউকে পেছনে তোলা হবে না । এমন কি আকাশ নিজেও কোন দিন মিতুর স্কুটিতে ওঠে নি । এতে নাকি ওর আত্মসম্মানে বাঁধবে । মিতু তারপর লুকিয়ে ঝুকিয়ে রাইড শেয়ার দিতো । আকাশকে বলতো না । জানতে সে রাগ করতো !
মিতুর চাকরি পাওয়ার কথা শুনে আকাশ সত্যিই খানিকটা মুখ গোমড়া করে বসে ছিল । আকাশ সবে মাত্র ক মাস আগে চাকরিতে ঢুকেছে । তবে চাকরিটা সাধারণ এক চাকরি । বেতনের পরিমান মোটামুটি । তবে সেটা মিতুর বেতনের ধারে কাছেও না ।
আকাশ কেমন একটা প্রশ্নই করেছিল যে কিভাবে চাকরিটা হল ?
আকাশের কন্ঠে এমন কিছু ছিল যেটাতে মিতু খানিকটা দমে গিয়েছিল । তখন মনে হয়েছিল যে আকাশকে এখন এই ব্যাপারে কিছু না বললেই হয়তো ভাল হত । আকাশের এই আচরনটা মিতুর পরিচিত । এই দেশে এমন অনেক পুরুষ মানুষই এটা মেনেই নিতে পারে না যে তার বউ/প্রেমিকা তার থেকে বেশি টাকা আয় করবে । মিতুর নিজেরও মন খারাপ হল । আকাশকে কি সে তাহলে বদলাতে পারবে না ?
তারপর থেকেই মিতু লক্ষ্য করতে শুরু করলো যে আকাশের সাথে ওর দুরত্ব বাড়ছে । আগের মত আর ওর দিকে ঠিক যেন নজর দিচ্ছে না সে । মিতুই নিজ থেকে খোজ খবর নিতে শুরু করলো কিন্তু সেটাতেও যেন প্রান ছিল না । সেদিন খুব ছোট্ট একটা ব্যাপার নিয়ে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল ।
সম্পর্কের শুরু থেকেই ওদের মাঝে যে কথা হত তখন আকাশই সব সময় ফোন দিতো । ওর ভাষ্য ছিল যে মিতু তো চাকরি করে না ও টাকা পাবে কোথায় ! টিউশিন টাকা দিয়ে ওর নিজের হাত খচরের চলার একটা ব্যাপার আছে ।
চাকরি পাওয়ার পরে একদিন মিতু কল দিয়ে কথা বলছে । আকাশ কল কেটে কল দিলো । মিতু কেবল বলেছে কল কেটে কল দেওয়ার দরকার ছিল না । আর যাবে কোথায় ! অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিল । এখন চাকরি পেয়েছে বলে টাকার অনেক গরম দেখাচ্ছে আগে তো এমন ছিল এই সেই । মিতু প্রথমে একটু অবাক হলেও এক পর্যায়ে সেও কথার জবাব দেওয়া শুরু করলো । ফলাফল তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে গেল । তারপর থেকেই দুজনের মধ্য কথা বলা বন্ধ আছে ।
মিতু উঠে দাড়ালো । বেসি দেরি করা যাবে না । নয়তো ফারাজ চৌধুরী হয়তো রেগে যেতে পারে। তিনি অপেক্ষা করতে মোটেই পছন্দ করে না । অফিসে জয়েন করার পর এই কদিনে একবারো ফারাজ চৌধুরীর সাথে ওর সরাসরি দেখা হয় নি, ও দুর থেকে কেবল দেখেছে । কেন জানি মিতুর নিজেরও এই মানুষটাকে ভয় করতে শুরু করেছে । অফিসের সবার মত সেও ফারাজকে ভয় পেতে শুরু করেছে । এই ভয় চাকরি চলে যাওয়া নয়, অন্য কিছু একটা । এটা মিতু কোন ভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারবে না । প্রথম সেই পান্থপথ সিগনালে ফারাজ চৌধুরীর কন্ঠে শুনে কেমন সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল এখনও এই অফিসে যতবার সে ফারাজ চৌধুরীর গলা শোনে ততবারই এই সংকুচিত অনুভব করে । কেন করে সেটা সে নিজেই জানে না । মিতু আস্তে আস্তে হাটতে লাগলো এমডির ক্যাবিনের দিকে । একটু একটু যেন ভয় পাচ্ছে সে !