দ্য ডার্ক প্রিন্স (পর্ব সাত)

ফারাজ কফির কাপটা হাতে নিয়ে মিতুর দিকে তাকালো । মিতুর হাতেও কফির কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে জানলার পাশে । এক ভাবে তাকিয়ে আছে বাইরে । বাইরে বেশ কিছু সময় ধরে ঝড় হচ্ছে । কাঁচটা একটু খুলে দেওয়া । সেখান থেকে মাঝে মাঝেই প্রবল বাতাস আচ্ছে । তার সাথে বৃষ্টির পানি । মিতু চুপ করে সেদিকে তাকিয়ে আছে । 

আজকে তৃতীয় বারের মত ওরা এসেছে আশুলিয়াতে সাইটের কাজ দেখতে । আসার পর থেকে ঝড় শুরু হয়েছে । বাধ্য হয়েই কোম্পানির রেস্ট হাউজে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ওদের ।
-আর ইউ ওকে ?
ফারাজের কথা শুনে মিতু যেন খানিকটা চমকে উঠলো । জানালা থেকে ওর দিকে ফিরে চাইলো ।
-জি স্যার !
ফারাজ বলল
-তুমি ঠিক আছো ?
-জি স্যার !
-কদিন ধরেই দেখছি তোমার মনোযোগ মাঝে মাঝেই অন্য দিকে চলে যায় ? কি ভাবো এতো ?
মিতু মাথা নিচু করে রইলো কিছুটা সময় । তারপর আবারও মাথা তুলল । ফারাজ এখনও ওর দিকে তাকিয়ে আছে । মিতু বলল
-কিছু না স্যার ! আসলে ....
-রিলেশনশীপ প্রব্লেম ?
মিতু কিছু বলল না । তবে একটু মাথা ঝাকালো !
ফারাজ হাসলো একটু । মিতু হয়তো জানেও না ওর ব্যাপারে সব তথ্য ফারাজের কাছে আছে । ছোট বেলা থেকেই মিতু ওর বড় মামার কাছে মানুষ হয়েছে । বলতে গেলে ওর জীবনে উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা নেই । আকাশ নামের একটা ছেলের সাথে ওর বেশ কয়েকদিন ধরে প্রেম চলছে । তবে কদিন থেকে সম্ভবত সেই সম্পর্কে ঝামেলা চলছে । খোজ করলে আরও গভীরের খবর হয়তো বের করা যাবে কিন্তু ফারাজ আর চেষ্টা করে নি । আপাতত এই টুকুই চলবে । পরের খবর পরে ।
হঠাৎ মিতু বলল, আকাশের ইচ্ছে আমি বিয়ের পর চাকরি না করি । তার কেবল ঘরের বউ দরকার যে তার জন্য রান্না করবে ঘরদোর সামলাবে ! এমন বউ দরকার তার !
ফারাজ বলল, তুমি এমন বউ হতে চাও না !
মিতু কিছু না বলে কেবল মাথা ঝাকালো ।
-তাহলে তাকে বুঝিয়ে বল ! যদি সে ভালবাসে তাহলে সে বুঝবে !
-চেষ্টা করেছি । হয় নি । বুঝে নি ।
-তাহলে আর কি !
ফারাজ কফিতে চুমুক দিয়ে পেছন ফিরতে যাবে, এমন সময় মিতু বলল, আপনি কাউকে ভালবাসেন নি কোন দিন ?
প্রশ্নটা শুনে ফারাজ হঠাৎ থেমে গেল । ও খানিকটা অবাক হল মিতুর প্রশ্নটা শুনে । গত চার পাঁচ বছরে এমন প্রশ্ন কেউ ওকে করেছে কি না সে মনে করতে পারছে না । আজকে মিতু করে ফেলল । ফারাজ বলল
-আমি ?
-হ্যা । ইফ ইউ হ্যাভ নো প্রেব্লেম টু আনসার !
-ভালবাসা জিনিসটা ঠিক আমার সাথে যায় না । আই লাইক টু ডমিনেট !
মিতু প্রথমে কথাটা ঠিক যেন বুঝতে পারলো না । বোকার মত তাকিয়ে রইলো কেবল । ফারাজ হাসলো একটু । তারপর বলল
-বুঝতে পারছো না ?
-উহু !
-বুঝতে হবে না ।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়েই ফারাজ বের হয়ে এল ঘর থেকে । বাইরে ঝড়টা থেমে এসেছে । আবার সাইটে যাওয়া দরকার । কাজটা শেষ করে আবার ঢাকায় ফিরতে হবে ।
হাটতে হাটতে হঠাৎ ফারাজের মনে হল মিতুর কাছে হঠাৎ করে কথাটা সে কেন বলল ? এই কথাটা তো তাকে বলার কোন দরকার ছিল না । ফারাজের এই দিক টা মানুষ জানে না । খুব অল্প কিছু মানুষ জানে । মিতু ব্যাপারে সব কিছু যেন তার কাছে উল্টোপাল্টা হচ্ছে । মিতু কি সেই অল্প মানুষের মধ্যে পড়ে না ।
ঐদিনের ব্যাপারটা এখনও ফারাজের কাছে পরিস্কার হয় নি । কিভাবে মিতু ওর কাছে ওখানে পৌছালো সে বুঝতে পারছে না । অনেক ভাবেই জানার চেষ্টা করেছে ! নাকি মিতুর ঐদিন পৌছানোর ব্যাপারে তার হাত আছে !
সব সম্ভাবনা এসে এখানেই শেষ হয়ে যায় !
যদি ব্যাপারটা এমন হয় তাহলে মিতুর সামনে কঠিন বিপদ ! এই বিপদ থেকে ওকে কিভাবে বাঁচাবে সে ? ওর কি সেই ক্ষমতা আছে ?
ফারাজের হঠাৎ খুব অসহায় লাগলো । মিতুর জন্য ওর চিন্তা হতে লাগলো । নাতাশা চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে । এর মানে নতুন কাউকে তার দরকার ! সেটা মিতু হোক ফারাজ এটা চায় না । মেয়েটার মাঝে নিষ্পাপ একটা ভাব আছে । এই মেয়েটাকে সে বিপদে ফেলতে চায় না । কোন ভাবেই চায় না। কিন্তু কি করার আছে ওর !
মিতু বারান্দায় দাড়িয়ে ফারাজের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । একটু আগের বলা কথাটা এখনও মিতুর মাথায় ঘুরছে । আই লাইক টু ডমিনেট । ফারাজের মনভাব এমনিতেও খুব কর্তৃত্বপরায়ন । তাহলে আবার নতুন কি ডমিনেট করতে পছন্দ করে সে । মিতুর মাথায় এই জিনিসটা ঢুকলো না । তবে সে অন্য কিছু বুঝিয়েছে । মনের ভেতরে একটা কৌতুহল জেগেই রইলো । কিন্তু সেটা কিছুতেই মিটলো না । কিভাবে মিটাবে সেটাও বুঝতে পারছিলো না ।
আরেকবার কি জিজ্ঞেস করবে সে ?
না ! এইবার জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না । সে পরিস্কার ভাবেই বলে দিয়েছে যে মিতুর এতো কিছু বুঝতে হবে না । আবার যদি জানতে চায় তাহলে সত্যিই রাগ করতে পারে । আর মিতু কোন ভাবেই ফারাজকে রাগিয়ে দিতে চায় না ।
মিতু ভেবেছিলো আজকে ঢাকায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে । তবে কাজ গুলো আগে আগেই শেষ হয়ে গেল । সন্ধ্যার কিছু আগে আগেই ওরা ঢাকাতে পৌছে গেল । চলার পথে ফারাজ বলল
-মিতু তোমাকে কোথায় নামিয়ে দিবো বল ?
-কেন স্যার অফিসে যাবেন না ?
-না আজকে আর ভাল লাগছে না । বাসার দিকে যাবো ভাবছি !
-তাহলে আমাকে এই কালসীর কাছে নামিয়ে দিলেই চলবে । আমি এখানে থেকে চলে যেতে পারবো ।
-শিওর ? বল তো বাসায় কাছে নামিয়ে দিতে পারি !
-না স্যার দরকার নেই ।
মিতুর একবার ইচ্ছে হল বলে যে স্যার আমাকে বাসার কাছেই বরং নামিয়ে দেন কিন্তু সেটা বলতে পারলো না । মিতুকে বাসার কাছে পৌছে দিতে গেলে গাড়িটা অনেক ঘুরতে হবে । নিজের প্রয়োজনে অন্য কাউকে এতো ঝামেলায় ফিরতে ইচ্ছে করলো না । আর ফারাজকে তো নয়ই ।
মিতু কালসী মোড়ের কাছেই নেমে গেল । গাড়িটা চলে যেতে দেখলো ও । মিতু কিছু সময় সিএনজির জন্য অপেক্ষা করলো কিন্তু একটা খালি সিএনজি কিংবা ট্যাক্সিও পেল না । এখান থেকে ওর বাসাটা বেশ দুরে । চাইলেও রিক্সা করে যাওয়া যাবে না । আর সিএনজি না পেলে বাসে উঠতে হবে । এখন এই বাসে উঠতে ওর মোটেই ভাল লাগে না ।
এখন স্কুটি টা থাকলে কত ভাল হত ! চাকরিতে জয়েন করার পরেও মিতু স্কুটি করে চলাচল করতো । কিন্তু এখন সেটা কমে গেছে অনেক । বেশির ভাগ সময় ওকে ফারাজের গাড়িতে চলতে হয় । স্কুটিটা পড়ে থাকে অফিসের গ্যারেজে । এই জন্য বেশির ভাগ দিনই ও আর স্কুটি নিয়ে যায় না ।
বাস থেকে যখন মিতু নামলো তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে । বাসস্ট্যান্ড থেকে ওর বাসাটা আরও মিনিট দশেকের পথ । মিতু কিছু সময় অপেক্ষা করলো রিক্সার জন্য । কিন্তু আজকে রিক্সাও পেল না । এদিকটাতে একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে । এমন কি যখন ও বাসে ছিল তখনও বৃষ্টি পড়ছিলো । আর বৃষ্টি পড়লে রিক্সা পাওয়া যায় না । আর কিছু না ভেবে মিতু হাটতে শুরু করলো ।
রাস্তাটা ওর কাছে কখনই ভাল লাগে না । বেশ অন্ধকার মত । স্ট্রিট লাইট লাগালেও এখানে সেগুলো থাকে না । চুরি হয়ে যায় । পুরো রাস্তায় একটা মাত্র মাত্র লাইট জ্বলছে । মিতু আর কিছু না ভেবে হাটতে লাগলো ।
কিছুদুর গিয়েছে তখনই পেছন থেকে আলো দেখতে পেল । পেছনে তাকিয়ে দেখলো যে একটা মইক্রো আসছে । পথটা একটু আলোকিত হয়ে গেল । মিতুর ভয়টা কেটে গেল । আলো দেখলো সব সময় বুকে সাহস আসে । কিন্তু এই আলো মিতুর জন্য ভাল কিছু বয়ে আনে নি !
মাইক্রোবাসটা ঠিক ওর গা ঘেসে থামলো । মিতু কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজাটা খুলে গেল । দুটো হাত বের হয়ে এল সাথে সাথে । কেউ মিতু কে শক্ত করে ধরেই টান দিল মাইক্রোর ভেতরে । পুরো ঘটনা ঘটতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগলো । মিতু এতোটাই বিস্মিত হয়ে গেল যে চিৎকার করতে ভুলে গেল কিছু সময় । ততক্ষনে মাইক্রোর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে ।
মিতু যখন চিৎকার করতে যাবে তখনই ওর মুখ শক্ত করে চেপে ধরলো একজন । তারপর মুখের কাছে মুখ এনে হিসহিস করে বলল,
"চিৎকার করবি না খবরদার । একেবারে মেরে ফেলবো"
মিতুর চিৎকারটা মাঝ পথেই আটকে গেল । ভয়ে নয়, বিস্ময়ে ! কারন ওর মুখ চেপে ধরা মানুষটা ওর খুব পরিচিত একজন মানুষ !