দ্য ডার্ক প্রিন্স (পর্ব ছয়)

পরের সপ্তাহে মিতুর জীবনে আরও বড় রকমের কিছু পরিবর্তন দেখা দিল । এই পরিবর্তনের জন্য মিতু ঠিক তৈরি ছিল না । সে খুশি হবে নাকি বেজার হবে সেটাও ঠিক বুঝতে পারছিলো না । 
মোহাম্মাদপুর থেকে ফারাজ চৌধুরীকে ঐভাবে ফেরৎ নিয়ে আসার পর থেকেই মিতু জীবনে প্রথম যে পরিবর্তন এসেছিলো সেটা হচ্ছে মিতুর সব সময় এটা মনে হতে থাকে যে ওকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে । এই
অনুভূতিটার থেকে ও কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না । এমন কি রাতে ঘুমাতে গেলেও তার মনে হচ্ছে কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে । এই অনুভূতি থেকে সে কিভাবে মুক্তি ভাবে সেটা বুঝতে পারছে না । 

দ্বিতীয় পরিবর্তনটা এল এক সপ্তাহ পরেই । দ্বিতীয় বারের মত ওর ডাক পড়লো ফারাজ চৌধুরীর কেবিনে । ও তখনও জানে না কেন ওকে ডাকা হয়েছে । হাসপাতাল থেকে আসার পরে মিতুর এই আশা ছিল যে ফারাজ ওকে ডাক দিয়ে কিছু বলবে । কিন্তু সেটা করে নি । মিতু খানিকটা হতাশ হয়েছিলো ফারাজের নির্জিবতা দেখে । পরে অবশ্য নিজের মনকে বুঝিয়েছে । 

কেবিনে চুপ করে বসে রইলো কিছু সময় । ফারাজ নিজের ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কি যেন কাজ করছিলো । সেখান থেকে চোখ না তুলেই মিতুকে বলল, কাজ কর্ম কেমন চলছে ?
মিতু এখনও অবাক হয়ে দেখলো ওর বুকের ভেতরে সেই অনুভূতিটা হচ্ছে । একটা অজানা অনুভূতি । খানিকটা ভয়ের মত তবে ঠিক ভয় না । সামনের মানুষটা ওর সাথে এখনও পর্যন্ত চোখ গরম করেও কথা বলে নি তবুও তার মনে এই অনুভূতি হয় কেন কে জানে ! কোন ব্যাখ্যা সে খুজে পায় নি । মিতু বলল
-ভাল স্যার !
-তোমার ক্লাসের কি খবর ?
-ক্লাস স্যার চলছে ! 
-প্রতিদন ক্লাস না করলে সমস্যা হয় না ?
-না স্যার । সমস্যা নেই । জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো ! কেবল পরীক্ষা দিলেই চলে । 
-ও গুড ! কারন সামনে তোমার ব্যস্ততা বাড়বে আরও !
-বাড়বে !
-হ্যা । আগামীদিন থেকে তুমি আমার পিএ হিসাবে কাজ করবে । নাতাশা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে তো জানোই । ওর স্থানটা তুমি নিবে কাল থেকে ! 

মিতুর মনে হল ওর বুকের ভেতরে যে একটা ধাক্কাটা এসে লাগলো । ফারাজ চৌধুরীর পিএ হওয়ার মানে হচ্ছে ওকে এখন থেকে সব সময় ফারাজের সাথে সাথে থাকতে হবে । ব্যাপারটা ভাবতেই ওর পুরো শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে এল । 
ফারাজ বলল, কোন সমস্যা নেই তো ? 
মিতুর খুব বলতে ইচ্ছে করলো যে না আমি স্যার সব সময় আপনার সাথে সাথে থাকতে চাই না । আমি তাহলে হার্ট এটাক করে মারা যাবো কিন্তু বলতে পারলো না । আপনা আপনি মাথা টা দুই দিকে ঘুড়ে জানালো যে তার কোন আপত্তি নেই । ফারাজ বলল, গুড ! তোমার কাছে নতুন এপোয়েন্ট লেটার পৌছে যাবে আজকেই । 
একটু সময় কি যেন ভাবলো । তারপর বলল, কাল থেকে নয় তুমি বরং আজ থেকে পোস্ট টা সামলাও । আমি একটু পরে আশুলিয়ার দিকে যাবো আমাদের নতুন ফ্যাক্টারির কাজ দেখতে । তুমি চল আমার সাথে । 
মিতু আবারো রোবটের মত বলল, জি স্যার ! 

মিতু গাড়ির সামনের সিটে বসে ছিল চুপ করে । কি করবে ঠিক বুঝতে পারছিলো না । ফারাজ চৌধুরী পেছনের সিটে বসে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কাজ করছে । তারা দুজন ছাড়াও গাড়িতে ড্রাইভার আছে । সে যেন আরও একটা রোবট । সামনের দিকে ছাড়া একবার ডানে বাঁয়েও তাকাচ্ছে না । মিতু খুব অস্বস্তিবোধ করছে ।
অফিসে বসে কাজ করতেই বরং ওর ভাল লাগতো । কোন ঝামেলা ছিল না । নিজের কাজ গুলো মন দিয়ে করতো । সেখানে সবাই অনেকটাই ওর পরিচিত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এখানে কেউ নেই । সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা আর সব সময় ভয়ে ততস্থ হয়ে থাকা । মিতু কি করবে বুঝতে পারছে না ! 

সারা দিনের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে মিতুর রাত হয়ে গেল । যখন বাসায় পৌছালো তখন মনে হল এখন কেবল ওর ঘুম দরকার । কিন্তু বাসায় ওর জন্য নতুন সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো । দরজার সামনে এসেই লক্ষ্য করলো ওদের বাসায় আজকে বেশ কিছু মানুষ এসেছে । 
কলিংবেল চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল । ড্রয়িং রুমের ভেতরে ঢুকেই মিতু বড় রকমের ধাক্কা খেল । রুমে আকাশ বসে আছে । আকাশের পাশের একজন মাঝ বয়সী মহিলা । মহিলাকে সাথে সাথেই চিনে ফেলল সে । আকাশের মা । আরেকজন পুরুষ মানুষও রয়েছে । 

মিতু ঠিক বুঝতে পারছিলো না কি হচ্ছে ! ওর সব কিছু বুঝতে একটু সময় লাগলো । 
আকাশ এসেছে ওদের বাসায় । ওর বাবা মায়ের সাথে !

মিতু কিছুটা সময় চুপ করে দাড়িয়ে রইলো মূর্তির মত করে । আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো । ওর মামা পাশেই ছিল । ওর দিকে তাকিয়ে বলল, মিতু দেখ কারা এসেছে ! 
মিতু কিছু ভাবতে পারছিলো না । হঠাৎ মনের ভেতরে একটা আনন্দের রেখা দিল । যাক শেষ পর্যন্ত আকাশের রাগ ভেঙ্গেছে । এবং ও সরাসরি ওর বাসায় এসে হাজির হয়েছে । 

মিতুর আর ভেতরে যাওয়া হল না । ওকে আকাশের পাশেই বসতে দেওয়া হল । ওর সামনেই কথা বার্তা চলতে লাগলো । আকাশের নতুন একটা চাকরি হয়েছে ব্যাংকে । বেশ ভাল বেতন । এখন আকাশ এবং আকাশের পরিবার চায় মিতুকে বউ করে ঘরে তুলতে । সেই বিষয়েই কথা বার্তা হচ্ছে । মিতুর মুখটা সমাান্য লাল হয়ে উঠছিলো । ভাল লাগা মিশ্রিত একটা লজ্জার অনুভূতি কাজ করছিলো ওর ভেতরে । 

আকাশের মায়ের কথা গুলো শুনতে পাচ্ছিলো । আকাশের মা মিতুর মামাকে বলছিলো, জানেনই তো ভাই সাহেব আজকাল আর একটা ভাল মেয়ে পাওয়া কত কঠিন ! আকাশ যখন মিতুর কথা বলল আমার মনে হয়েছে এর থেকে ভাল মেয়ে আর পাবোই না । তাই চলে এলাম । এখন ওদের বিয়ে দিয়ে সংসার মিতুর হাতে তুলে দিবো ও সামলাবে ! আমি আর নেই ! 
মিতুর মানা বলল, সত্যিই বলেছেন । নিজের ভাগ্নি বলে বলছি না তবে ছোট বেলা থেকে মিতু অনেক গুণী । সব সময় নিজের কাজ নিজে করে । পড়াশুনা শেষ করতে না করতে দেখেন চাকরিও করা শুরু করেছে । বিয়ের পরে চাকরি আর সংসার ঠিকই সামলে নিবে সে । আপনারা কোন চিন্তা করবে না !

কথাটার শেষ হতেই আকাশের মা বলল, কি যে বলেন ভাইসাবে চাকরি করে কি আর সংসার করা যায় ! মিতু নিশ্চয়ই চাকরি করবে না । আর আকাশ খুব ভাল চাকরি করে । মিতুর চাকরি করার দরকার কি ! 

মিতুর হঠাৎ সব ভাললাগা মুহুর্তের মাঝে গায়েব হয়ে গেল । আকাশের মতই ওর মায়ের মনভাব । মিতু হঠাৎ বলল, আন্টি আমি বিয়ের পরেও চাকরি করতে চাই !
মিতু দেখতে পেল আকাশের মায়ের মুখের হাসি মুছে গেল । তবে সেটা সাথে সাথেই ফিরে এল । মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়ে তোমার চাকরি করার দরকার ? আকাশ একাই সামলাতে পারবে সব কিছু আর ওর বাবারও কম নেই । এক মাত্র ছেলে আমাদের !
মিতু বলল, আন্টি আমি বলছি না আকাশ সামলাতে পারবে না । সে ঠিকই পারবে ! কিন্তু সে পারবে তার মানে এই তো না যে আমাকে তার উপর নির্ভরশীল হতে হবে ! 
আকাশ মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, মিতু কি বলছো এসব ? আমাদের মাঝে কথা হয়েছে এটা নিয়ে !
মিতু বলল, আমাদের মাঝে এটা কথা হয়েছে কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে আসি নি আমরা ! 
আকাশের মা বলল
-দেখো মেয়ে ঘরের ভেতরে থাকে, বাইরে থাকবে ছেলেটা । ভেতরটা সামলাবে মেয়েরা বাইরেটার পুরুষেরা । এমনই হয়েছে সব সময় !
-কিন্তু এখন সময় বদলেছে । আমি চাকরি করতে চাই । যখন আমার নিজের মনে হবে যে আমার চাকরি করতে ভাল লাগছে না তখন আমি চাকরি ছাড়ার কথা ভাববো ততদিন পর্যন্ত চাকরি করবো !

আকাশে এবার হঠাৎ একটু রেগে উঠলো । মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, মিতু এই ভাবে আমার মাকে অপমান করতে পারো না ?
মিতু অবাক হয়ে বলল, অপমান কোথায় করলাম ? উনার সাথে কখন খারাপ ব্যবহার করলাম ? আমি কেবল আমার ইচ্ছের কথা বলেছি ! সম্মান করা মানে কি এই যে একজন যা নিজের ইচ্ছেটা আমার উপর জোর করে চাপিয়ে দিবে এবং আমাকে সেটা মেনে নিতে হবে ! দেখো আকাশ আমি আগেই তোমাকে বলেছি, এখনও বলছি আমি তোমার সাথে সংসার করতে চাই সত্যিই চাই । কিন্তু তার মানে এই না যে আমাকে আমার ইচ্ছে বিষর্জন দিয়ে তুমি যা বলবে তাই শুনতে হবে ! যদি এমন বউ চাও যে যে তোমার কথায় উঠবে বসবে তাহেল সরি সেই বউ আমি হতে পারবো না । তুমি আমাকে চেনো ! 
ঘরে যে আরও কয়েকজন মানুষ আছে সেটা ওরা দুজন ভুলেই গেল । আকাশ বলল, তার মানে আমার ইচ্ছের কোন দাম নেই তোমার কাছে !
-অবশ্যই আছে কিন্তু তোমারই সেটা বুঝা উচিৎ ! সংসারে কেবল টাকা আয় করাটাই বড় ব্যাপার না । নিজের একটা আইডেন্টিটির ব্যাপার থাকে । এখন আমি যদি তোমাকে বলি তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসার সামলাও আমি খরচ চালাবো করবে তুমি ? করবে না ? তাহলে একই কাজ আমাকে করতে বলছো কেন ? 
-আমার চাকরি আর তোমার চাকরি এক হল ?
-এক হবে না কেন ? আমাকে যে বেতন দিবে সেটা কি ভিনদেশী ? কারেন্সী তো একই তাহলে সমস্যা কোথায় ? তোমার টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া দেওয়া যাবে আমার বেতনের টাকা দিয়ে যাবে না ? 

আকাশের মুখটা আরও বেশি লাল হয়ে গেল । মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, এতো কিছু আমি শুনতে চাই না । আমি এখনই শুনতে চাই যে তুমি চাকরি ছাড়বে কি না ! নয়তো আমাদের মাঝে আর দেখা হবে না । এখানে সব কিছু শেষ ! 
মিতুর ঘরের  প্রতিটি মানুষের মুখের দিকে তাকালো । সময় যেন থেমে গেছে । 
মিতু একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল । তারপর বলল, আমি চাকরি ছাড়বো না । এটাই শেষ কথা আমার ! 

আকাশ কিছু সময় মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর আর কোন কথা না বলে নিজের বাবা মা কে নিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে ! বড় মামা বলল, কি হয়ে গেল ?
মিতু বলল, বাদ দাও মামা । 
-আরেকবার ভেবে দেখতিস ! ছেলেটাকে পছন্দ যেহেতু করিস !
-না মামা ! আর ভেবে দেখার মত কিছু নেই । তুমি চাও যে আমার অবস্থা আমার মায়ের মত হোক ! সে ঐ মানুষটার উপর নির্ভর করেছিলো বলেই আজকে এমন হচ্ছে তার সাথে, আমার সাথে ! আমি এটা চাই না । 
মামা হাসলো ! তারপর বলল, তুই যা ভাল বুঝিস ! 
মিতু বলল ব্যাগ থেকে মিষ্টির একটা প্যাকেট বের করলো । সেটা নিচে নামিয়ে রাখলো । তারপর মামার দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে আমার প্রোমোশন হয়েছে ! 
মামার দিকে আরেকটা হাসি দিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেল । তাহলে দীর্ঘ্য দিনের সম্পর্কটার একটা সমাপ্তি ঘটলো । মিতুর মন খারাপ হল একটু । বাথরুমে ঢুকে ঠান্ডা পানির নিচে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুটা সময়! চোখ দিয়ে কান্না বের হয়ে আস্তে লাগলো । চোখের পানি আর ঝর্ণার পানিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল ।