দ্য ডার্ক প্রিন্স (পর্ব দুই)

সিগনাল জ্যামে গাড়িটা বসে আছে অনেকটা সময় । এই সকাল বেলাতেই এতো সময় নষ্ট হবে সেটা ফারাজ চৌধুরী বুঝতে পারে নি । বাসা থেকে এখানে আসতেই এক ঘন্টা লেগে গেল । আরও কত সময় লাগবে কে জানে । মনে মনে তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে কিন্তু এই রাগটা সে কার উপর প্রকাশ করবে সেটা বুঝতে পারছে না । গাড়ির সামনের সিটে তার পিএ নাতাশা বসে আছে। এসি চলছে তবুও মেয়েটা একটু একটু ঘামছে । বসের মেজাজ খারাপ হচ্ছে সেটা সে ভাল করেই বুঝতে পারছে । আর বসের মেজাজ খারাপ হলে যে তার ভয় পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে সেটাও সে খুব ভাল করেই জানে ! 

ফারাজ বলল, বায়ারদের আসার কথা কখন ?
নাশাতা যেন এই প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলো । বলল, স্যার চিন্তা করবেন না । আমরা পৌছে যাবো !
-কয়টায় আসবে ?
-স্যার সাড়ে বারোটায় ।
-কিভাবে পৌছাবও শুনি ? আর ওখানে গিয়ে আমার একটা প্রস্তুতির ব্যাপার আছে । এসব ব্যাপার তুমি আগে ভাববে না ? এখানে যে জ্যামে পড়তে পারি সেটা তোমার জানার কথা নয় ?
ফারাজ দেখলো নাতাশার মুখ শুকিয়ে গেছে । সে জানে অফিসের সবাই তাকে জমের মত ভয় পায় । কেন পায় সেটাও ফারাজের খুব ভাল করেই জানা আছে । তার বাবা অফিস চালাও খুব শান্ত ভাবে । কিন্তু সে অফিস চালায় খুব কড়া ভাবে । কারো একটু ভুল সে বরদাস্ত করে না । এই ভয় পাওয়াটা ফারাজ মনে মনে উপভোগও করে । এই যেমন এখন নাতাশা ভয় পাচ্ছে । যদিও মেয়েটার ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই । এখানে যে এই ভাবে জামে আটকে থাকতে হবে এটা তার আগেই ভাবা দরকার ছিল । কিন্তু সে ভাবে নি ।
নাতাশা বলল
-স্যার একটা উপায় আছে ?
-কি উপায় ?
-আমি একটা পাঠাও ডাকি ?
-কাজ হবে ?
-হ্যা স্যার হবে । বাইক তো! আপনাকে এদিক ওদিক দিয়ে নিয়ে যেতে পারবে !
কিছু সময় চিন্তা করে ফারাজ বলল
-আচ্ছা, ডাক দাও ।
ফারাজের হঠাৎ সেই অনুভূতিটা ফেরৎ এল । মাথার ভেতরে একটা অদ্ভুদ যন্ত্রনা শুরু হল !
ওহ নো !
আবার শুরু হচ্ছে !
নিজের মোবাইলের দিকে তাকালো । আজকে ১১ তারিখ । সময় এখনও আসে নি । তবুও এখনও কেন শুরু হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রনাটা ! এমন তো হওয়ার কথা না । ফারাজ নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করলো । কোন ভাবেই আত্মনিয়ন্ত্রন হারানো চলবে না । একটু কিছু ভাবতে হবে ! অন্য দিকে মনযোগ টা নিয়ে যেতে হবে ! তাহলে এটা চলে যাবে !
ইদানিং এই যন্ত্রনাটা ঘন ঘন চলে আসছে । যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন এটার উপর থেকে ফারাজের নিয়ন্ত্রন চলে যাচ্ছে । এমন হলে সামনে তাকে বিপদে পড়তে হবে । এখনও পর্যন্ত সব কিছুই সে সামাল দিয়ে চলেছে । কিন্তু ব্যাপারটা ঘন ঘন ঘটতে লাগলে তার পক্ষে সামলানো মুসকিল হয়ে যাবে ।
-স্যার !
নাতাশার কথায় ফারাজ আবার বাস্তবে ফিরে এল । বলল
-হ্যা ?
-রাইড রেডি । ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন আমাদের সামনে একটা লাল রংয়ের স্কুটি । ওটা !
-ঐ মেয়ের স্কুটিতে উঠবো ?
-স্যার এর থেকে কাছে আর কেউ নেই । এটা ক্যান্সেল করতে গেলে দেখা যাবে অন্য রাইডার আসতের আরও সময় নিচ্ছে । এটাই কাছে এবং সিগনালের একেবারে সামনে । আমি চাইলে চলে যেতে পারবেন সহজে ।
ফারাজ আবারও নিজের রাগটাকে নিয়রন্ত্রন করলো । সে জানে যতবার সে রেখে যাবে ততবাই কোন না কোন অঘটন ঘটবে । সেই ঘটনাটা আরও দ্রুত ঘটবে । ফারাজ বলল, নাম কি রাইডারের ?
-স্যার রাইডার নাম মিতু ।
আর কিছু শোনার দরকার মনে করলো না ফারাজ । গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এল । বাইরে বের হতেই কড়া রোডের একটা একটা ধাক্কা তার মুখে লাগলো । চোখে সানগ্লাসটা পরে নিল । তারপর এগিয়ে চলল স্কুটিটার দিকে ।
ফারাজ যখন নিজের অফিসের সামনে এসে থামলো তখন খানিকটা অবাকই হল । প্রথমে রাইডার উপরে তার খুব একটা ভরশা ছিল না । চেহারা দেখেই মনে হচ্ছিলো মেয়েটার ভেতরে একটু আত্মবিশ্বাসের অভাব । কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা ঠিক আধা ঘন্টার ভেতরেই ওকে পৌছে দিল ওর অফিসের সামনে ।
ফারাজ স্কুটি থেকে নেমে বলল,
-ভেরি ওয়েল ডান মিস মিতু ! আপনি আমাকে সময়ের দুই মিনিট আগেই পৌছে দিয়েছেন ।
তারপর মানিব্যাগ থেকে একটা এক হাজার টাকার নোট বের করে দিল মিতুর হাতে । আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফারাজ হাটতে লাগলো অফিসের দিকে । মনে মনে ভাবলো মেয়েটা নিশ্চয়ই এক হাজার টাকা পুরোটুকু পেয়ে খুব খুশি হবে । আজকে আর হয়তো রাইডই নিবে না। বাসায় গিয়ে আরাম করবে কিংবা বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরে বেড়াবে !
আচ্ছা মেয়েটার কি কোন বয়ফ্রেন্ড আছে ?
নিজের চিন্তা ভাবনা দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল । কোথাকার কোন রাইডারর বয়ফ্রেন্ড আছে কি না সেটা নিয়ে সে কেন ভাবছে ! এটার কোন কারন আছে ক?
আবারও নিজের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রন করে নিল । এসব চিন্তার করা তার মানায় না । সে খানিকটা ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই অফিসের লিফটের বোতাম চাপ দিলো । যদিও একটু পরেই যে তার এই মেজাজটা আর ঠিক থাকবে না সেটা আর কার জানা ছিল ।
ঠিক আধা ঘন্টা পরে ফারাজ চৌধুরীর অফিসের ভেতরে যেন লঙ্কাকান্ড শুরু হল । অফিসের সবাই ভয়ে একেবারে চুপসে আছে । ফারাজ অনেক চেষ্টা করেও নিজের রাগ কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না । জাপান থেকে যে বায়ারদের আসার কথা ছিল, তাদের আসতে সে মানা করে দিতে বাধ্য হল । যে ফাইল সে রেডি করতে বলেছিল অফিসে এসে দেখে সেটার কিছুই তৈরি হয় নি । যাকে তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছিল সে অফিসে আসে নি । তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না ।
কনফারেন্স রুমে ফারাজ সবার দিকে কেবল অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । সবাইকে বকাঝকা করতে লাগলো । একজন কোন মতে বলার চেষ্টা করলো যে মিথিলা ম্যাডামের কাজ ছিল এটা । তারা কি করবে কিন্তু তাকে আরও জোরে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল ।
সবাই এখন জানে ফারাজ চৌধুরী এখন আস্তে আস্তে তাদের পুরানো সব অকাজের ফাইল বের করবে । তারপর সবাই উপরে এক বস্তা কাজের চাপ বসাবে । প্রতিবার এমনই হয় । যখনই কেউ কোন ভুল করে, তখন অফিসের সবাইকেই তার ফল ভোগ করতে হয় ।
ফারাজ চৌধুরী সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ থেকে ......
তার কথা মাঝ পথেই থেমে গেল । তার কারন হচ্ছে তার চোখ চলে গেছে কনফারেন্স রুমের দরজার দিকে । সেটা খুলে একজন ঘরে উকি দিয়েছে । ফারাজ মুখটা দেখেই খানিকটা অবাক হয়ে গেল । এই মেয়ে এখানে কি করছে?
মেয়েটা খানিকটা ভিত মুখে পুরো রুমের দিকে একবার চোখ বুলালো । ফারাজের উপর চোখ পড়তেই খানিকটা আস্তত্ব হল মনে হল । ফারাজের বিস্ময় তখনও কাটে নি । সে সেই বিস্ময় নিয়েই বলল, ইয়েস ?
মিতু বলল, আপনার টাকা !
ফারাজ প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না । কিসের টাকার কথা বলছে মেয়েটা !
মেয়েটা এবার ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো ফারাজের দিকে । রুমের প্রতিটা মানুষ মিতুর দিকে তাকিয়ে । কেউ কোন কথা বলছে না । বলার সাহস পাচ্ছে না ।
মিতু ফারাজের সামনে এসে হাতে ধরে টাকা টাকাটা ফারাজের টেবিলের উপরে রাখলো । তারপর বলল, আপনার সাতশ ষাট টাকা । রাইডে দুইশ এক চল্লিশ টাকা এসেছে ।
টাকাটা টেবিলের উপর রেখে মিতু আবার ধীর পায়ে দরজার দিকে হাটতে লাগলো । ওর বুকের ভেতরটা তখনও খানিকটা ঢিপ ঢিপ করছে ।
ফারাজ টাকাটা হাতে নিল । তারপর বলল, মিস মিতু, প্লিজ স্টপ !
মিতু দাড়িয়ে পড়ল । ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকালো ফারাজের দিকে ।
ফারাজ বলল, আপনি পড়াশুনা কতদুর করেছেন ?
মিতু একটু দম নিয়ে বলল, অনার্স ফাইনাল ইয়ার চলছে ।
-আপনার পুরো নাম কি ?
-হামিদা বিনতে খায়ের ।
ফারাজ তার সামনে বসা আলিম আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল, আলিম সাহেব, আপনি এখনই মিথিলার টারমিনেশন লেটার টাইপ করুন । আর সেই স্থানে মিস হামিদা বিনতে খায়ের অরফে মিতুকে এপোয়েন্ট করুন ।
তারপর মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, মিতু ইয় আর হায়ার্ড । কাল থেকেই আপনি এই অফিসে জয়েন করবেন । আলিম সাহেবের সাথে যান । উনি আপনাকে আপনার কাজ আর আপনার ডেস্ক বুঝিয়ে দিবে ।
এরপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আজকের মিটিং এখানেই শেষ । যে যার কাজে যান ।
সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো । আজকে আর বাড়তি কোন কিছু তাদের উপর চাপানো হয় এটা দেখেই তারা সবাই খুব খুশি । সবাই দ্রুত কনফারেন্স রুম ছেড়ে চলে যেতে লাগলো ।
মিতু তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে । তার এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না একটু আগে কি হয়ে গেল । ফারাজ গ্রুপে তার চাকরি হয়ে গেছে । এমন অদ্ভুদ ভাবে !