স্কুটি
চালাতে মিতুর সব সময় ভাল লাগে । নিজেকে একটু স্বাধীন স্বাধীন মনে হয় । মিটারে যত
গতি বাড়াতে পারে তত যেন ভাল লাগে । কিন্তু আজকে যতই মিটারে গতির কাটাটা বাড়তে ওর
টেনশন যেন আরও বাড়ছে । এতো রাতে এর আগে কোন দিন সে বাইরে বের হয় নি । আজকেও বেশ
হওয়াটা মোটেই ঠিক হয় নি । তবে মনের ভেতরে সেই অনুভূতিটা এতো তীব্র হচ্ছে যে বাড়ির
বাইরে না বেরিয়ে সে পারে নি ।
কেবল ফারাজ চৌধুরীর কারনেই নয়, যদি অন্য কোন পরিচিত মানুষের বেলাতেও এমন তীব্র ভাবে সে অনুভূব করতো
তাহলে হয়তো এতো রাতে ঠিকই বের হয়ে আসতো । ওর কাছে কেবল মনে হচ্ছে যে মানুষটা বিপদে
আছে । এখন তাকে সাহায্য করতে হবেই । সেই সাহায্য করতেই এগিয়ে চলছে সে ।
যতই
এগিয়ে যাচ্ছে মোহাম্মাপুরের দিকে ততই রাস্তাটা একেবারে জন শূন্য হয়ে যাচ্ছে । এই
রাতের বেলা এমনিতেও মানুষজন একদমই নেই । তবুও যখন বাসা থেকে বের হয়েছে দুএকজনকে
ঠিকই চোখে পড়ছিলো রাস্তার এদিক ওদিক । কয়েকটা গাড়িকেও ভুসভাস করে চলে যেতে দেখলো
বিপরীত দিকের রাস্তা দিয়ে । আর মাঝে মাঝেই ট্রাক দেখতে পাচ্ছিলো ।
কিন্তু
যখনই মোহাম্মাদপুরের বসিলা ব্রিজটা পার হল তখন মিতুর কাছে মনে হল যেন ও অন্য কোন
জগতে চলে এসেছে । চারিপাশে একটা জনপ্রাণীও নেই । মানুষ তো দুরের কথা একটা কুকুরকেও
দেখতে পাচ্ছে না । নির্জন রাস্তা একাকী দাড়িয়ে আছে । মাঝে মাঝে রাস্তার
ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে । সেই আলোতে আন্ধকার যেন আরও বেশি ঘন করে
তুলছে । মিতুর বারবার মনে হচ্ছে এখনই স্কুটি ঘুরে ফিরে যেতে । খুব বড় সম্ভবনা আছে
যে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে মিতু কিছুই দেখতে পাবে না । তাকে এমনি এমনি ফিরে আসতে
হবে । আবার এমনও হতে পারে যে সেখানে গিয়ে সে নতুন কোন বিপদে পড়বে । যে কোন কিছু
হতে পারে !
মিতুর
মোবাইলের দিকে তাকালো । ম্যাপটা অনুযায়ী আরও কিছুটা পথ যেতে হবে । মিতু সামনে
এগিয়ে যেতে থাকে । আরও মিনিট পাঁচেক চলার পরই মিতু বজলু বোডিং স্টোরের সামনে এসে
থামে । অবাক হয়ে কিছু সময় এদিক ওদিক তাকাতে থাকে । একটু আগে ও যে স্বপ্নটা দেখেছে, সেখানে যেমনটা দেখেছিল এই চারপাশটা একেবারেই সেই রকম । একটুও এদিক ওদিক
নেই । মিতু কেবল অবাক হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলো ! এমনটা কি করে সম্ভব ?
মিতু কোন
দিন এই দিকে আসে নি । তাহলে স্বপ্নে কিভাবে এই জায়গাটা দেখটে পেল ?
মিতুর
কাছে কোন উত্তর নেই । আর ঠিক তখনই সেই আওয়াজটা শুনতে পেল !
কারো
ব্যাথায় কাতরানোর আওয়াজ !
বুকের
ভেতরটা কেঁপে উঠলো আবার !
স্বপ্ন
অনুযায়ি ফারাজের ঠিক ডান দিকে রাস্টার পাশে পড়ে থাকার কথা । স্কুটি থেকে নামলো সে
। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলো সেদিকে । বেশি যেতে হল না । রাস্তার পাশেই
একজন কে পড়ে থাকতে দেখতে পেল । বজলু বোডিংয়ের কাছে জ্বলতে থাকা আলোতেই সেই
মানুষটাকে দেখতে পেল সে । যদিও এতো দুর থেকে মোটেই চেহারা চেনা যাচ্ছে না তবে
মিতুর কোন সন্দেহ নেই যে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মানুষটা ফারাজ ছাড়া আর কেউ নয় ।
মিতু
দৌড়ে সেদিকে এগিয়ে গেল । ফারাজের চেহারাটা ঠিক মত চেনাও যাচ্ছে না । ও মোবাইলের
আলো ফেলে আরও ভাল করে ফারাজকে দেখতে লাগলো । মনে হচ্ছে যেন কোন ভয়ংকর জন্তু
ফারাজের উপর আক্রমন করেছে । মিতু কি করবে বুঝতেই পারলো না ।
হাটু
গেড়ে বসলো ফারাজের পাশে !
ফারাজ !
স্যার
কথাটা মুখ দিয়ে বের হল না !
ফারাজ
কোন মতে চোখ মেলে তাকালো । মিতুর চেহারাটা সে দেখতে পেল কি না মিতু বুঝতে পারলো না
। মিতুর মনে হল ফারাজ যেন ওকে চিনতে পেরেছে । ওর চোখে বিস্ময়ভাবটা দেখতে পেল !
ফারাজ
মৃদু স্বরে বলল, মিতু !
-ফারাজ !
আপনার এই অবস্থা কে করলো ! কিভাবে ভাবে এসব হল !
ফারাজ
মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর অনেক কষ্টে বলল, তুমি চলে যাও ! তোমার জন্য নিরাপদ নয় এটা !
মিতু কি
বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । ফারাজ ওকে চলে যেতে বলছে । কিন্তু মিতু খুব ভাল করেই
জানে ওর পক্ষে ফারাজকে এভাবে একা ফেলে চলে যাওয়া সম্ভব না ।
মিতু
কিছু সময় কেবল তাকিয়ে রইলো ফারাজের দিকে । কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না । ওকে
এখানে একা রেখে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব না । কিন্তু কিভাবে নিয়ে যাবে ওকে ।
মোবাইলটা
হাতে নিয়ে ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করতে গিয়েই টের পেল মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই । একটু আগেও
ছিল কিন্তু এখন নেই ।
এখন ?
কিছু সময়
কোন পথ খুজে পেল না । তারপরই একটা উপায় মাথায় এল ! কাজটা কত খানি নিরাপদ সেটা মিতু
বলতে পারবে না তবে মনে হল এর থেকে ভাল উপায় আর নেই ।
স্কুটিটা
ও ফারাজের কাছে নিয়ে এল । এরপর ফারাজকে ওনেক কষ্টে স্কুটির পেছনে বসালো । ফারাজকে
বলল, আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকুক ! পারবেন না ?
ফারাজ
কোন মতে মাথা নাড়ালো । তবে মিতুর ঠিক ভরশা হল না । মতে হতে লাগলো যে স্কটু চলতে
শুরু করলে হয়তো ফারাজ পড়ে যাবে । তাই ওড়না দিকে নিজের শরীরের সাথে ফারাজের শরীরটা
বেঁধে নিল । অন্তত এখন ফারাজ পরে যেতে গেলে ও আগে থেকেই টের পাবে ।
স্কুটিটা
স্টার্ট দিতে যাবে তখনই মিতুর মনে একটা অদ্ভুদ অনুভূতি হল । ওর কেবল মনে কেউ যেন
ওকে দেখছে । ওর দিকে চোখ রাখছে !
মিতুর
মনে হল এখনই এখান থেকে দ্রুত চলে যাওয়া দরকার !
এরপর
কিভাবে যে ও হাসপাতালে পৌছালো মিতু বলতে পারবে না । ফারাজকে হাসপাতালে ইমাজেন্সিতে
ভর্তি করে জোরে জোরে দম নিতে লাগলো । যখন একটু সুস্থির হতে পালরো নিজের দিকে
তাকিয়ে দেখলো ওর পুরো জামা কাপড়ে ফারাজের রক্ত লেগে আছে ! ফারাজের রক্ত !
ঠিক
দুইদিন পরে ফারাজ চোখ মেলে তাকালো । হাসপাতালের সুসজ্জিত বিছানায় নিজেকে আবিস্কার
করলো কিছু সময় যেন বুঝতে পারলো না কি করবে ! রুমের ভেতরেই কয়েকজনকে দেখতে পারলো ।
ওর পরিবারের কয়েকজন ! বাবা মা ছাড়াও দুজন আত্মীয়কে চিনতে পারলো সে । নিজেদের মধ্যে
কথা বলছে । ওর চোখ খুলেছে সেটা এখনও টের পায় নি তারা !তারপরই চোখ গেল মেয়েটার উপর
!
মিতু !
সাথে
সাথেই সব কিছু মনে গেল । ভাসা ভাসা ভাবে ওর মনে পড়লো সব । এই মেয়েটাই সেখানে ছিল !
কিন্তু
কিভাবে পৌছালো সেখানে ! কোন ভাবেই মিতুর সেখানে পৌছানোর কথা না । তাহলে কিভাবে
পৌছালো সে !
ফারাজ
একটু নড়াচড়া করতেই ফারাজের মা এগিয়ে এল ।
-কেমন
লাগছে এখন ?
-ভাল মা
!
ফারাজের
চোখ তখনও মিতুর দিকে । মিতুও সেটা বুঝতে পেরেছে যে ফারাজ ওকে দেখছে ! ফারাজের
চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করেই ফারাজের মা বলল
-মিতুই
তোকে নিয়ে এসেছে এখানে । মেয়েটাই আমাদের খবর দিয়েছে ! ও না থাকলে কি যেন হত !
ফারাজ
কোন কথা বলল না । এই ঘটনা এই নতুন না । এর আগেও এই রকম হয়েছে । এই ভাবেই সে
হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আহত হয়ে । কারন কেউ বলতে পারে না । এমন কি ফারাজ নিজেও সঠিক
ভাবে জানে না । প্রতিবার কোন অপরিচিত হাসপাতালে সে জেগে ওঠে । তারপর কাছের মানুষ
গুলো আসতো ছুটে । কিন্তু আজকে চোখে মেলেই পরিচিত মানুষ গুলোকে দেখতে পেয়ে ভাল
লাগছে ।
হঠাৎ
করেই ফারাজ সবাইকে রুম থেকে চলে যেতে বলল । কেবল মিতুকে থাকতে বলল । ওর মিতুর সাথে
কথা বলা দরকার । ওর মনে এখনও অনেক প্রশ্ন । মেয়েটা কিভাবে ওর খোজ পেল !
মিতুকে
প্রশ্নটা করতেই মিতু কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলো ফারাজের দিকে । কি বলবে সেটা
যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না । ফারাজ বলল,কই বল ?
কিভাবে আমার খোজ পেলে ?
মিতু
খানিকটা সময় আরও ইতস্তত করে বলল, স্যার আপনি বিশ্বাস করবে
না । হাসবেন !
ফারাজ
এবার একটু বিরক্ত হল । তারপর খানিকটা কঠিন গলাতেই বলল, বলতে বলছি বল । বাড়তি কথা কেন বল ।
মিতু বলল, স্যার স্বপ্নে !
-মানে ?
-মানে
স্যার আমি ঐদিন রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম । তখনই স্বপ্নে দেখলাম আপনি রাস্তায় পড়ে আছেন ।
স্বপ্নটা এতো বাস্তব মনে হল যে ঘুম ভাঙ্গার পরেও মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না । মনে
হচ্ছিলো যে সত্যিই আপনি সেখানে আছেন । স্বপ্নের ভেতরেই জায়গাটার নাম দেখেছিলাম ।
গুগল ম্যাপে সার্চ দিতেই চলে এল । তারপর আর কিছু না ভেবে স্কুটি নিয়ে বের হয়ে পড়ি
।
ফারাজ
কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল,আমাকে যখন খুজে
পেলে তখন সেখানে কেউ ছিল ?
-না
স্যার কেউ ছিল না । তবে .....
লাইনটা
বলবে কিনা বুঝতে পারছিলো না । ফারাজ বলল,
-তবে ?
-তবে
স্যার আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো কেউ আমাকে দেখছে । আশে পাশে তাকিয়ে অবশ্য কাউকে
খুজে পাই নি ।
ফারাজ
বলল, কাজটা ভাল হয় নি । ঐভাবে ঐ জায়গাতে রাতের বেলা একা একা
যাওয়াটা মোটেই ঠিক হয় নি তোমার । যদি কিছু হয়ে যেত ! কোন বিপদে পড়লে !
মিতু কোন
কথা বলল না । ফারাজ বলল
-তারপরেও
তোমাকে ধন্যবাদ । তুমি এবার বাসায় যেতে পারো ! অফিসে যাওয়া লাগবে না আজকে । ছুটি !
মিতু রুম
থেকে বের হয়ে গেল । ফারাজ সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছু টা সময় । এখনও মিতুর কথা গুলো
মাথায় ঘুরছে ওর ! মেয়েটা কিভাবে ওকে স্বপ্নে দেখলো ? এমনটা
কোন ভাবে সম্ভব ? মেয়েটার সাথে ওর পরিচয় হয়েছে অদ্ভুদ
ভাবে । সেদিন কি মনে করে ওকে চাকরিটা দিয়েছিলো সেটা ফারাজ নিজেও জানে না । তখন
মেজাজ এতো খারাপ ছিল যে ঐ মেয়েটাকে অফিস থেকে বের করে দিতে মন চাইছিলো । তাই
করেছিল সে কিন্তু সেখানে মিতুকে সে কেন নিয়োগ দিল সেটার ব্যাখ্যা ওর নিজের কাছে
নেই । তবে এটা বুঝতে পারলো যে মিতুর ব্যাপার তার এখন থেকে আলাদা মনযোগ দিতে হবে ।