দ্য ডার্ক প্রিন্স (পর্ব চার)

মিতুর শোবার খাটটা একেবারে জানালার পাশে । শুয়ে শুয়ে আকাশটা খুব ভাল করে দেখা যায় । ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বিল্ডিংই একটার সাথে অন্যটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেড়ে উঠছে । পাশের বাসার দেওয়াল ছাড়া জানলা দিয়ে আর কিছু দেখা যায় না কিন্তু মিতুর জানালা থেকে এখনও আকাশটা বেশ ভাল ভাবেই দেখা যায় । 

প্রায়ই দিনই সে এই আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের আকাশের কথা ভাবে । কিন্তু আজকে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে ফারাজ চৌধুরীর কথা । ছেলেটার মাঝে কি এমন আছে যে তার সামনে গেলেই অন্য চিন্তা ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । বুকের ভেতরে একটা অজানা অনুভূতি কাজ করছে । এই অনুভূতিকে ঠিক ভয় বলা যাবে না । কিন্তু সেই অনুভূতির কোন নাম ওর জানা নেই ।
চাকরিতে ঢোকবার পর থেকে গতদিন প্রথম বারের মত মিতু ফারাজ চৌধুরীর কেবিনে গিয়ে হাজির হয়েছিল। সেদিনের পর এই প্রথম মুখোমুখী বসেছিল । মনের ভেতরে সেই অজানা অনুভূতিটা এতো তীব্র ভাবে এর আগে অনুভব করে নি । একটু একটু কাঁপছিল । ফারাজ যখন বলল, তুমি ঠিক আছো?
কন্ঠটা যেন তীব্র ভাবে এসে ওর বুকে লাগলো । একটু যেন কেঁপেও উঠলো । তারপর কোন মতে বলল, জি স্যার ঠিক আছি !
-কাজ কর্ম কেমন লাগছে ?
-ভাল স্যার । সবাই খুবই ফ্রেন্ডি আর হেল্পফুল ।
-গুড ।
এর পরে ফারাজ পকেট থেকে একটা এক টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল ওর দিকে । মিতু খানিকটা কৌতুহল নিয়ে তাকালো । ফারাজ বলল
-তুমি আমার কাছে এক টাকা পাও মনে আছে ? ঐদিন ৭৬০ টাকা ফেরৎ দিয়েছিলে । যদিও আমার ৭৫৯ টাকা ফেরৎ পাওয়ার কথা ছিল । তাই না ?
মিতু খানিকটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । এই এক টাকার কথা যে ফারাজ চৌধুরীর মনে থাকবে সেটা সে ভাবতেও পারে নি । ফারাজ বলল
-তুমি যেমন ঋণ পছন্দ কর, এই জন্যই সেদিন টাকা ফেরৎ দিতে এসেছিল আমি ঋণী থাকতে পছন্দ করি না ।
মিতু হাত বাড়িয়ে টাকা নিল । একেবারে চকচক করছে নোট টা । মাত্রই সম্ভবত ব্যাংক থেকে নিয়ে আসা হয়েছে । একটু একটু যেন উষ্ণ অনুভব হচ্ছে । মিতুর নোট টা হাতে বেশ কিছু সময় সেটার দিকে তাকিয়েই রইলো ।
ফারাজ বলল, আচ্ছা তাহলে কাজ কর ।
চলে আসার সময় মিতুর আবাবও সেই অনুভূতিটা তীব্র হচ্ছিলো । এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নেই তার কাছে ।
ফারাজের চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে সে ফোন টা হাতে নিল । আজকে কত দিন আকাশের সাথে তার কথা হয় । ছেলেটা যেন ওকে একেবারে ভুলেই গেছে । অবশ্য ও নিজেও ফোন দেয় নি । আজকে আর রাগ ধরে রাখলো না । আকাশকে ফোন দিয়েই ফেলল ।
একবার দুইতিন তিন বার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু আকাশ ফোন ধরলো না । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বারোটা পার হয়ে গেছে । আকাশ এতো জলদি তো ঘুমায় না । তাহলে ফোন কেন ধরছে না ? এখনও রাগ করেই আছে । ফেসবুকে ঢুকে আকাশকে খুজে পেল না । আকাশের আইডি ডিএকটিভ নয়তো ওকে ব্লক করে রেখেছে । একটা দীর্ঘ্যশ্বাস বের হয়ে এল ওর ভেতর থেকে । মোবাইলের স্ক্রিনটা অফ করে চোখ বুঝলো । কালকে আবার অফিস যেতে হবে।
মিতু রাতের অন্ধকারের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে । ফাঁকা একটা রাস্তা ।
রাস্তাটা ওর অপরিচিত । এর আগে এখানে এসে বলে তার মনে পড়ছে না । চারিদিকে তাকিয়ে কিছু খোজার চেষ্টা করছে । কাউকেই আসে পাশে দেখা যাচ্ছে না, পুরো স্থানটা যেন একটা মৃত্যুপুরি মনে হচ্ছে । এখানে কিভাবে এল ও?
একটা আওয়াজ কানে এল ওর । কেউ যেন ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছে ! এদিক ওদিক খুজতে লাগলো আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে সেটা দেখার জন্য । ডান দিকে তাকাতেই একটা অস্বাভাবিকত্ব চোখে পড়লো । রাস্তার ঠিক পাশেই একজন কে পড়ে থাকতে দেখলো । অন্ধকারের ভেতরেও নড়াচড়াটা চোখে পড়লো । মিতু কি করবে ঠিক বুঝতে পারলো না প্রথমে । তারপর আর কিছু না ভেবে এগিয়ে গেল সেই মানুষটার দিকে ।
মানুষটার সামনে এসে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো আহত মানুষটা আর কেউ নয়, তাদের কোম্পানীর এমডি ফারাজ চৌধুরী । পুরো শরীরে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এতো রক্ত দেখে মিতুর মাথা ঘুরে উঠলো ।
এটা কোন ভাবেই সত্যি হতে পারে না । ও নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে ! নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে !
কিন্তু স্বপ্নে কি লাল রং দেখা যায় ? মিতু জানে যে স্বপ্ন কেবলই সাদা কালো হয়। তাহলে এতো জীবন্ত কেন মনে হচ্ছে ।
তখনই শব্দটা শুনতে পেল ! ফারাজ বলল, মিতু হেল্প !
মিতু ফারাজের কাছে হাটু গেড়ে বসলো । না ! এটা স্বপ্ন হতে পারে না ।
স্বপ্ন কি এতো বাস্তব হয় ? ফারাজ কে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে । নয়তো ওকে বাঁচানো যাবে না । কিন্তু কিভাবে নিয়ে যাবে ও ! ও তো জায়গাটার নামই জানে না !
আর এখানে কিভাবে এল সেটাই তো বুঝতে পারছে না । কিছুই মনে পড়ছে না।
মিতু আরেকবার চারিদিকে তাকালো । জায়গা কোথায় সেটা চেনার জন্য !
এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো !
ঐতো একটা দোকান দেখা যাচ্ছে দূরে । একটু আলো দেখা যাচ্ছে দোকানের সামনে । আরেকবার ফারাজের দিকে তাকিয়ে মিতু ঐ দোকানের দিকে এগিয়ে গেল । আগে জায়গাটার নাম ওর জানা দরকার !
দোকানের নামটা পড়তে পারলো । বজলু বেডিং স্টোর ! নিচে লেখা কলিঘাট বসিলা, মোহাম্মাদপুর !
মিতু আবারও ফারাজের কন্ঠস্বর শুনতে পেল । ওর নাম ধরে ডাকছে । মিতু আবারও ঘুরে দাড়ালো । তারপর ফারাজের দিকে আবার দৌড় দিল । কিন্তু মাঝ পথেই হোচট খেয়ে পড়লো ।
সাথে সাথেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল । বিছানা থেকে উঠেও মিতু বড় বড় দম নিতে লাগলো । এতো সময় স্বপ্ন দেখছিল বিশ্বাস হচ্ছিলো না । এতো জীবন্ত স্বপ্ন হতে পারে না । মিতুর চোখে ফারাজের চেহারা ভাসতে লাগলো । যদি সুত্যিই ফারাজ বিপদে পড়ে থাকে তাহলে ?
মিতু জোর করে চিন্তাটা দূর করে দিতে চাইলো কিন্তু কোন লাভ হল না । বারবার মনে হতে লাগলো যে ফারাজ বিপদে আছে । ওর সাহায্য দরকার !
কিন্তু কিভাব সে সাহায্য করবে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারলো না ।
তখনই মিতুর মনে পড়লো দোকানটার নাম ! “বজলু বেডিং স্টোর” কলিঘাট, বসিলা, মোহাম্মাদপুর ! হাতে ফোন টা নিয়ে গুগল ম্যাপস বের করে ঠিকানাটা লিখলো সে । এবং ওকে অবাক করে দিয়ে সত্যিই একটা পয়েন্ট দেখালো । আসলেই কালিঘাট বসিলা আছে মোহাম্মাদপুরে ।
মিতুর মনে হল কাজটা করা খুবই বোকামি হবে কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলো না সে । ওর কেবলই মনে হচ্ছে ফারাজ ওর কাছে সাহায্য চেয়েছে । ওর এখনই সাহয্য করতে হবে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত দুইটা একুশ । এতো রাতে বাইরে হওয়াটা কত বড় বোকামি হবে সেটা মিতু খুব ভাল করে জানে তাও আবার একটা স্বপ্নের কারনে । কিন্তু কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলো না সে । বারবার মনে হচ্ছে যে মানুষটা সেখানে পড়ে আছে । তার সাহায্যের জন্য আশে পাশে কেউ নেই ।
আর থাকতে পারলো না । যা হওয়ার হবে । খুব ধীরে পোশাক পরে নিল সে । তারপর স্কুটির চাবিটা হাতে নিয়ে বের হয়ে এল দরজা দিয়ে । যখন গেট দিয়ে স্কুটিটা বের করে রাস্তায় দাড়ালো তখনো মিতুর মনে হচ্ছিলো যে বড় বোকামি করতে চলেছে । সেখানে গিয়ে দেখা যাবে কিছুই নেই ! উল্টো নতুন কোন বিপদ বাঁধিয়ে বসে আছে !
চিন্তাটা মন থেকে দুর করে দিলো সে । যা হওয়ার হবে ! এখন আপাতত ওর গন্তব্য হচ্ছে বজলু বোডিং স্টোর, কলিঘাট বসিলা, মোহাম্মাদপুর ! মোবাইল ডিরেকশন অন করে দিলো । সময় দেখাচ্ছে বাইকে করে যেতে ৩৩ মিনিট লাগবে । মিতু আরেকটা বড় দম নিয়ে স্কুটি স্টার্ট দিল ।