তোরাব আলী লস্কর । বিখ্যাত ডাকাত । লস্কর চরের নেতা সে । তার নাতনী হল জোহরা । এই চরের আরেকজন উল্লেখযোগ্য আরেকজন ডাকাত হচ্ছে হানিফ। সে এই চরের সম্ভব্য নেতা । জোহরাকে যে খুবই পছন্দ করে ।
অন্য দিকে আজাহার খন্দকার নবীগঞ্জের পাটব্যবসায়ী । তার দুই ছেলে মনসুর আর মঞ্জুর । বড় ছেলে মনসুর মেডিক্যালে পড়ে । ছোট ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে। বড় ছেলে মনসুরকে ডিএমসি থেকে গ্রামে নিয়ে হাজির হয় । দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি ছেলেকে ঢাকা আসতে দিবেন না ।
গল্পের কাহিনী শুরু হয় তোরাব আলী লস্কর যখন আজাহার খন্দকারের কাছে চিঠি পাঠায় এই বলে যে আগামী বুধবার সে লোকজন নিয়ে তার আড়তে আসবে। সে যেন আড়তে পর্যাপ্ত পরিমান টাকা পয়সা রাখে । কিন্তু আজাহার খন্দকার সেটা না করে পুলিশে খবর দেয় । সে টাকা দিতে রাজি নয় । এক বুধবার ঠিকই ডাকাতেরা আসে এবং পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয় । দুইজন ডাকাত ধরা পড়ে এবং একজন মারা পরে ।
তোরাব আলী লস্কর কিছু না করে চুপ করে বসে থাকলেও জোহরা একটা ভয়াবহ সাহসের কাজ করে ফেলে । সে পুলিশের কাছ থেকে আটক দুইজন আসামীকে ঠিকই ছাড়িয়ে নিয়ে যায় । এভাবে জোহরা আরও কিছু সাহসীকতা কাজ করে ফেলে । তোরাব আলী হঠাৎ লক্ষ্য করে লস্কর চরের সব কিছু আর তার নিয়ন্ত্রনে নেই । লস্কর চরের সবাই তোরাব আলী থেকে জোহরার কথা বেশি শুনতে শুরু করে ।
এদিকে আরেক ঘটনা ঘটে । মনসুর দেলোয়ার হোসেনের মেয়ে কনার প্রেমে পড়ে । সে বাসায় এসে বাবা আজাহার খন্দকারের কাছে কনাকে বিয়ের কথা বলে । প্রথমে একবার বিয়ের ভেঙ্গে গেলেও নাটকীয়তার মাঝে মনসুর আর কনার বিয়ে হয়ে যায় । চমৎকার ভালবাসাময় একটা জীবন শুরু করে তারা । কনা খন্দকার বাড়িতে এসে সবাইকে আপন করে নেয় । খন্দকার সাহেবও যেন নিজের ছেলের বউ নয়, কনাকে পেয়ে নিজের মেয়েকে পেয়েছেন এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।
অন্য দিকে জোহরা আবারও লস্করের চর থেকে বাইরে বের হয়ে আসে । তার পালিত কন্যা মায়াকে ডাক্তার দেখাতে আসে । সেখানে সে প্রায় ধরা পড়তে যায় কিন্তু এক পুলিশ সদস্যকে চরম ভাবে আহত করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । তারপর সে আবারও আসে নবীগঞ্জে । এবার একেবারে পুলিশ ওসি মইনুল হোসের সামনে গিয়ে হাজির হয় সে । তাকে জিম্মি করে চর থেকে ধরে আনা মাছ বিক্রি করানোর ব্যবস্থা করে । তারপর যাওয়ার সময় আজাহার খন্দকারের পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায় ।
এই ক্ষতি আজাহার খন্দকার সহজে সামলে উঠতে পারেন না । মনসুর বাজারে একটা ডিসপেনসারি দিয়ে বসে । কদিনের ভেতরেই তার নাম ডাক হয়ে ওঠে ! আস্তে আস্তে সব কিছু সামলে উঠতে শুরু করে । কনা তখন গর্ভবতী হয়ে পড়ে । কনা হাজির হয় তার বাবা বাড়ি কদিন থাকার জন্য । কথা হয় যে এক সপ্তাহ পরে মনসুর গিয়ে তাকে নিয়ে আসবে । কিন্তু সে আসে না । পনেরদিন পরে আজাহার খন্দকার কনাদের বাসায় গিয়ে হাজির হয় এবং রাগারাগি করতে থাকে এই বলে যে তাকে একা রেখে সবাই এখানে কিভাবে শান্তিতে আসে । কনা তখন বলার চেষ্টা করে যে মনসুর তখনও তাকে নিতে আসে নি । আজাহার খন্দকার তখন বলে যে মনসুর কনাদের আসার তিন দিন পরেই নাকি লঞ্চে উঠেছিল ।
মনসুরের পঁচাগলা লাশ পাওয়া যায় আরও তিন দিন পরে । চেহারা চেনার উপায় ছিল না কারন লাশ একেবারে পঁচে গিয়েছিলো । তাকে চেনা যায় তার পরনের কাপড় দিয়ে । মনসুর যেদিন লঞ্চে উঠেছিলো সেদিক সেই লঞ্চে ডাকাত পড়েছিলো । কয়েকজন মারা গিয়েছিলো । তার ভেতরে মনসুর ছিল । কনা বিধবা হয়ে গেল ।
কিন্তু কাহিনী এটা না । কিছুদুর যাওয়ার পরে জানা গেল যে মনসুর মরে নাই । লস্করেরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে লস্করদের চরে । সেদিন লঞ্চে ডাকাত পড়লে মনসুর আহত একজনকে বাঁচায় । সেটা দেখে তোরাব আলী তাকে চরে নিয়ে যায় চরের লোকজনদের সেবা দেওয়ার জন্য ।
চরে এতে শুরু হয় নতুন ঝামেলা । জোহরা মনসুরের প্রেমে পড়ে । এটা দেখে হানিফের আবার সহ্য হয় না । সে একবার মনসুরকে খুন করার চেষ্টা করে কিন্তু সে বেঁচে যায় । ঐ দিকে কনাকে আবার তার বাবা মা বিয়ে দিয়ে উঠে পড়ে লাগে । তখন আজাহার খন্দকার মনসুরের ছোট ভাই মঞ্জুরের সাথে কনার বিয়ে ঠিক করে । পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে বিয়ে হয়ে যায় তাদের ।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে ওসি মইনুস হোসেন জানতে পারে যে মনসুর মরে নাই । জব্বার নামের একজন ডাকাত ধরা পড়ে তাদের হাতে । এদিকে চরে জোররা মনসুর আর তার মাঝ থেকে সরানোর জন্য হনিফকে উসকে দেয় জব্বারকে ছাড়িয়ে আনার জন্য । হানিফ যখন দলবল নিয়ে জব্বারকে ছাড়াতে যায় তখন পুলিশের হাত ধরা পড়ে । সেখান থেকে পরিস্কার ধারনা পায় যে মনসুর মরে নাই ।
এদিকে চরে আবারও তোরজোর শুরু হয় হানিফদের ছাড়িয়ে আনার জন্য । থানা হামলার জন্য বিরাট বড় দল নিয়ে তারা হাজির হয় নবীগঞ্জ । আসার পথে জোহরা মনসুরকে নিয়ে আসে সাথে করে । অবশ্য আসার কিছুদিন আগে মনসুর আর জোহরার মাঝে একটা বৃষ্টির রাতে কিছু ঘটনা ঘটে যায় । কি ঘটনা ঘটে সেটা আপনারা বুঝে নিন । মনসুরকে জোহরা তাদের ঘাটে নামিয়ে দেয় । তারপর তাকে বলে সে মনসুরকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছে ।
এই হচ্ছে নির্বাসনের ঘটনা । তার লেখার হাত ভাল । তবে এক ভাবে একটানা সারা দিন পড়া যায় না । গল্পের কাহিনী আমার সাথে ভাল মনে হয়েছে তবে একেবারে সেরা কিংবা এ ওয়ান অর্থ্যাৎ যেভাবে মানুষজন প্রসংশা করে সেই রকম মনে হয় নি । তার উপর তার আগের কদিন উপন্যাসের সাথে কাহিনী বর্ণনা একটা মিল আছে । আরেকটা খারাপ দিক আমার কাছে মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে আগের কটা উপন্যাসের মত কাহিনীতে সময় এগিয়ে গেছে আবারও কোথায় একেবারে থেমে । এইটা তার আগের সব কটা বইতেই দেখতে পেয়েছি । জানি না এটা হয়তো অনেকের কাছে কোন সমস্যা না কিন্তু আমার পড়তে গেলে কেমন যেন লাগে । মনে হয় উপন্যাসের বর্তমান কালের ঘটনা বর্ণনাতে সময়ের সামঞ্জস্যতা থাকা জরুরী ।
কিছু কিছু স্থানে কাহিনীর বর্ণনা অত্যন্ত বেশি । বিশেষ করে কনা আর মনসুর যখন কাল্পনিক ভাবে একে অপরের সাথে কথা বলে, সেগুলো পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এতো কথা বার্তা না লিখলেও হয়তো চলতো । এতো প্যাচালের দরকার কি !
তবে কিছু স্থানে কিছু কথা একেবারে মন ছুয়ে গেছে । কয়েকটা স্থানে কয়েক লাইন পড়ে আমি বই বন্ধ করে চুপ করে ভেবেছি কিছু সময় । মনে হয়েছে যেন ঠিক আমার মনের কথাটাই সে বলেছে । মনে হয়েছে আমিও তো ঠিক এই ব্যাপারটা এমন করে ভাবি । গল্পে মনসুরের কষ্ট কনার কষ্ট গুলো যেন আমি নিজে উপলব্ধি করতে পেরেছি । বই শেষ করার পরে মনে হয়েছে এমন ঘটনা কেন ঘটলো ওদের সাথে । এতোটা কষ্ট না পেলেও তো হত ।
তবে গল্প এমন স্থানে শেষ হয়েছে যে পাঠকের মনে আগ্রহ জাগতে বাধ্য যে এর পরে কি হল ? জোহরা যে থানা আক্রমন করতে যাচ্ছে সে বেঁচে ফিরবে তো ? এদিকে মনসুর যখন হাজির হবে নিজের বাসায় তখন কনার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে ? মনসুরের কেমন লাগবে যখন সে জানতে পারবে যে তার ছোট ভাইয়ের সাথে কনার বিয়ে হয়েছে ?
বইয়ের নাম নির্বাসন
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
অন্যধারা থেকে প্রকাশিত