দ্যা রাইট ওয়ান

ইশরাত আমাকে কোন দিন মুখ ফুটে বলে নি যে ও আমাকে পছন্দ করে । কিন্তু তার কাজ কর্ম দিয়ে ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমি যেন অন্য কোন দিকে না যাই, গেলে খবর আছে । এতোদিন তার আচরনও ঠিক সেই রকমই ছিল কিন্তু আজকে মেয়েটাকে কেমন যেন একটু অন্য রকম লাগছে । মনে হচ্ছে যেন ইশরাত খানিকটা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছে ।
কিসের উপর থেকে ?
আমার উপর থেকে ? 

ইশরাত সেই কখন থেকে আমার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে আছে । আজকে কাজ শুরু থেকে শুরু করে একবারও আমার সাথে দেখা করতে আসে নি । এসেছে লাঞ্চ আওয়ারে । এসে চুপ করে বসে আছে কেবল । কোন কথা নেই মুখে । অন্য দিন কতই না কথার খই ফুটতো মুখে !
আমি নিজের চেয়ার ছেড়ে গিয়ে ওর পাশের চেয়ারে বসলাম । তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
-কি হয়েছে বলবেন প্লিজ ?
-কিছু হয় নি ।
-তাহলে এরকম মুখ ভার করে বসে কেন আছেন !
-এমনি !

আমি আসলে জানি ওর মুখ কেন ভার ! কেন ওর মন খারাপ । কিন্তু আমি চাচ্ছি ব্যাপারটা ও নিজে থেকেই আমার কাছে জানতে চাক । তাহলে আমি ওকে সব বলতে পারি । আরও কয়েক মিনিট ও চুপ করে বসেই রইলো । তারপর হঠাৎ করেই মাথা তুলে তাকালো আমার দিকে । বলল
-নাদিরাকে আপনি কতদিন থেকে চেনেন ? ওর সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল ? এখনও আছে ?
-গোড়া থেকে বলি সব ? তাহলে হয়তো পরিস্কার বুঝতে পারবে ?
-বলুন !

আমি একটু দম নিয়ে নিলাম । অনেক কথা বলতে হবে । আমার বিশ্বাস সব শোনার পরে ইশরাত ব্যাপারটা বুঝতে পারবে । আমি বলা শুরু করলাম ।
-আমি শুরু থেকেই ছাত্র রাজনীতি করতাম ভার্সিটিতে । ক্ষমতাসীন দলের লোক ছিলাম তাই দাপট কম ছিল না । নাদিরা আমার ডিপার্টমেন্টেই ভর্তি হয় । আমার থেকে দু ব্যাচ জুনিয়র । একদিন লক্ষ্য করলাম অন্য দলের কয়েকটা ছেলে একটা মেয়েকে খুব টিজ করছে । একে তো আমার নিজের ক্যাম্পাস তার উপর আমার নিজের ডিপার্টমেন্টের মেয়ে । আর যায় কোথায় ! ঐ ছেলে গুলোকে সেই পেটালাম ।

ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেত কিন্তু হল না । দুদিন পরে সেই মেয়েটা নিজ থেকেই আমার খোজ বের করে আমাকে ধন্যবাদ দিল এমন কি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে লাঞ্চও করালো । এই মেয়েটাই নাদিরা । তারপর থেকে মেয়েটা আমার সাথে মাঝে মাঝেই দেখা করতো । একটা সময় বুঝতে পারলাম যে আমরা দুজন দুজনকেই পছন্দ করতে শুরু করেছি । একদিন সাহস করে বলেও ফেললাম । নাদিরা রাজিও হয়ে গেল ।
বছর খানেক সেই প্রেম করলাম দুজন ।

এই লাইন টা বলে ইশরাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখটা খানিকটা মলিণ হয়ে গেছে । আমি আবার শুরু করলাম ।
-ওর জন্য আমাকে রাজনীতি ছাড়তে হল । ওর এক কথাই ছিল যে রাজনীতি করা কোন ছেলেকে নাকি ওর ফ্যামিলি মেনে নেবে না । যাক ছেড়ে দিলাম আস্তে আস্তে । কদিন ঠিক ছিল সব তারপরেও আবার এল নতুন ঝামেলা । ওর বাসা থেকে নাকি ছেলে দেখছে । আমাকে কিছু করতে হবে । তখন সবে মাত্র আমার অনার্স শেষ হয়েছে । মাস্টার্স করতে গেলে হয়তো নাদিরার বিয়ে হয়ে যাবে তাই মাস্টার্স না করেই কাজে নেমে গেলাম । শুরুতে মার্কেটিং অফিসার হিসাবে যোগ দিলাম একটা কোম্পানীতে । বেতন ছিল কম তবুও আর কোন পথ ছিল না । মাস তিনেক পরে বেতন হাজার পনের মত হল । নাদিরাকে তখন বিয়ের কথা বলতে ও যে আকাশ থেকে পড়লো । এতো কম বেতনের চাকরী করলে নাকি ওর বাবা কিছুতেই রাজি হবে না । বললাম যে কয়েকটা দিন যাক বেতন বাড়বে !
ও কেন জানি আমার দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকালো । পরিস্কার জানিয়ে দিল যে আরও ভাল বেতনের চাকরি যোগার করতে হবে নয়তো কিছু হবে না ।


এই লাইণ গুলো বলে আমি খানিকটা চুপ করে রইলাম । কেন জানি পুরানো কথা গুলো বলে মনটা খানিকটা সিক্ত হয়ে উঠলো । ইশরাত আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তারপর ? তারপর কি হল ?
-তারপর আর কি ? লক্ষ্য করতে লাগলাম নাদিরা আস্তে আস্তে আমার সাথে যোগযোগ কমিয়ে দিচ্ছে । তারপর একেবারে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল । কেন জানি খুব জেদ চাপলো মনের ভেতরে । চাকরি করার সাথে সাথে এমবিএ ভর্তি হলাম । সেখান পাশ করে আজকে এই চাকরি ! আপনার সাথে পরিচয় !
-এখনও ওকে ভালবাসেন ?
-একসময় বাসতাম । খুব আশা ছিল যে জীবনের কঠিন সময় গুলোতে সে আমার পাশে থাকবে ! আমার হাত ধরে আমাকে বলবে যে ভয় নেই আমি আছি তোমার সাথে । কিন্তু সব আশা তো আর পুরন হয় না !
ইশরাত বলল
-এখন যদি সে চায় হাত ধরতে ?

আমি হেসে ফেললাম ।
-এখন তো আমার হাত ধরার দরকার নেই । আমি সেই কঠিন সময় পার চলে এসেছি । তখন যখন সে ছাড়া কেটেছে এখনও অবস্থা আরও ভাল । তাকে দরকার নেই ।

আমি জানি ইশরাত এসব কথা কেন জানতে চাচ্ছে । আসলেই ইশরাতের সাথে পরিচয় না হলে হয়তো নাদিরার সাথে আবার আমার দেখা হত না । এই ব্যাংকে এমটিও পদে আমি আর ইশরাত এক সাথেই জয়েন করেছি । সেই প্রথম দিন থেকেই মেয়েটার সাথে আমার ভাব হতে শুরু করে । সেটা তাও বছর খানেক আগের কথা । গত সপ্তাহে মেয়েটা আমাকে জোর করে তার এক আত্মীয়ের বিয়েতে দাওয়াত খেতে নিয়ে যায় । এবং সেখানে হঠাৎ করেই আমার আবারও নাদিরার সাথে দেখা হয়ে যায় । ইশরাত নিজে আমাকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো ।

সেই দিন রাতেই প্রায় বছর তিনেক পরে নাদিরা আমাকে ফোন দিল । অনেক কথা বলল । সে অনেক ভুল করেছে জীবনে । আসলে আমার মত নাকি আর কাউকে পায় নি । তার মানে ট্রাই করেছে । শেষে না পেয়ে আবার আমার কাছে ফেরৎ এসেছে । এখন তার বক্তব্য যে সে আবার ফিরতে চায় আমার কাছে ।

আমি ঐদিন ইশরাত কে কিছু বলি নি নাদিরার কথা । তবে বলবো বলবো করছিলাম । সময় আর সুযোগ পাচ্ছিলাম না । আজকে ওর মুখ দেখেই কেন জানি মনে হল ও ব্যাপারটা জেনে গেছে । আমি বললাম
-আপনি কিভাবে জানলেন নাদিরার কথা ?
-আজকে ও আমাদের বাসায় এসেছিল । আমাকে বলল আপনার সাথে নাকি ওর সম্পর্ক ছিল ।
-আর ?
-এখন নাকি আবারো আপনাদের সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে !
-তাই ?
-হু !
-তা আপনার কি মনে হয় ? ঠিক হবে ?

এই লাইণটা বলার সাথে সাথেই ইশরাত আমার দিকে তাকালো । আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম একভাবে । কালো ফ্রেমের চশমা টার ভেতর দিয়ে ওর গভীর চোখে পানি টলমল করছে । আমি হাত দিয়ে ওর চশমা টা খুলে নিলাম । চশমা ছাড়া খালি চোখটা আরও স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে । আমি বললাম
-আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আপনার কি মনে হচ্ছে ? আমি এখনও ঐ মেয়েকে ভালবাসি ?
-উহু !
-আর কি দেখছেন ? অন্য কারো জন্য ভালবাসা দেখছেন ? চশমা পরা কোন মেয়ের জন্য ?

ইশরাতের চোখ দিয়ে পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়লো । আমি ওর মুখের আরও একটু কাছে নিজের মুখটা নিয়ে গেলাম । তারপর ওর নাকে ছোট্ট করে একটা চুমু খেলাম । বললাম
-নাদিরার প্রতি আমার ভালবাসা ঐদিন শেষ হয়ে গেছে যদিন ও আমাকে ছেড়ে গেছে আরও ভাল অপশনের জন্য । অন্য দিকে আপনার সামনে আরও ভাল অপশন থাকা সত্ত্বেও আপনি কেবল আমাকেই পছন্দ করে আমাকে ধরে আছেন !


ভাল অপশান কেন বললাম মাস তিন আগে আমাদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার স্যার ইশরাতের সাথে তার ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বিয়ে দিতে চেয়েছিলো । কিন্তু ইশরাত সেটা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে । আমি একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম তবে ও রাজি না হওয়াতে জানে পানি এল । তখনই মনে হল এই মেয়ে আমাকে ছেড়ে যাবে না কোন দিন । অন্তত টাকা পয়সার জন্য তো নয়ই ।


ইশরাত আবার চশমা পরলো । শুরুর চেহারাটা ওর বদলাতে শুরু করেছে । আগের নিয়ন্ত্রন হারানো ভাবটা কেটে গিয়ে আবার আগের চেহারা ফিরে আসতে শুরু করেছে । আমি ইশরাত কে বললাম
-একটা কাজ করতে চাই
-কি কাজ ?
-তোমার ঐ আত্মীয় মানে নাদিরা একদিন দাওয়াত দিবা তোমার বাসায় ?
-কেন ?
-ঐদিন আমিও যাবো তারপর ওর সামনে আমি তোমাকে একটা চুমু খেতে চাই ।
-মানে কি কেন ?
-প্রতিশোধ বলতে পারো । ওকে ওর চেহরা দেখে আমি তখন পৌশাচিক আনন্দ পাবো !
-তুমি তো ফাজিল আছো বিরাট !
-আমি বদদের সাথে বদমাইশ করি ।
-না এসব করতে হবে না ।
-অবশ্যই হবে ।

যদিও ইশরাত রাজি হল না তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ও ঠিকই এই কাজটা করবে ।


আমার আসলেই নাদিরার জন্য কোন ভালবাসা অবশিষ্ট নেই । যে মেয়ে কেবল ভবিষ্যৎ সুখের জন্য নিজের ভালবাসা ভুলে নতুন কারো খোজে চলে যেতে পারে তার জন্য ভালবাসা থাকার কোন মানে নেই । আমি ইশরাতের জন্য ভালবাসা আছে । মেয়েটা যখন আমার হাত ধরেছে, আমার থেকে ভাল অপশান থাকা সত্ত্বেও আমাকে ত্যাগ করে যায় নি তখন সে আমাকে ছেড়ে যাবে না কোন দিন, অন্তত টাকা পয়সার জন্য তো নয়ই ।



(This part ends here)